আজ মঙ্গলবার ৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। হবিগঞ্জ জেলার চা বাগানগুলোতে নব্বই শতাংশই নারী চা শ্রমিক। নারীদের কষ্টে চা শিল্প টিকলেও হবিগঞ্জে অবহেলিত নারী চা শ্রমিকেরা।
নারী দিবসে চা শ্রমিকদের একজন জানান, চৌকিদারের ডাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাংসারিক সব কাজ করে সকাল ৮ টার মধ্যে কাজে বেরিয়ে পড়তে হয় তাঁদের। স্থানভেদে ৪-৫ মাইল পায়ে হেঁটে তারপর কর্মস্থলে পৌঁছাতে হয়। সাধারনত চা পাতা তোলা ও চা গাছ ছাঁটাই করা দুটি কাজ-ই নারী চা- শ্রমিকরা করে থাকেন, যা খুবই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষ করে বর্ষাকালে তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় । কেননা অনেক উঁচু উঁচু টিলা (ছোট পাহাড়) বেঁয়ে তাদেরকে চা পাতা সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়া যেহেতু চা গাছকে ঘিরে গভীর জঙ্গল বা আগাছা থাকে তাই সেখানে বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, বিচ্ছু, গজর(শুঁয়োপোকা), হাড়ি বরল(এক ধরনের বিষাক্ত মাছি যা চা গাছের ডালে মাটির হাড়ি বানিয়ে বাস করে), বিষাক্ত পিঁপড়া ইত্যাদির অবাধ বিচরণ । তারা এগুলোর কামড় খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাই এ গুলোকে বিষাক্ত বলে মনে করে না।
মাত্র ১২০( এক শত বিশ টাকা) টাকার বিনিময়ে সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা অবধি তাদেরকে কাজ করতে হয়। এর মধ্যে তারা দুপুর দুইটার সময় আধা ঘণ্টা সময় পাচ্ছে দুপুরের খাবারের জন্য। তখন বাড়ি থেকে আনা রুটি এবং তার সাথে মরিচ, পিঁয়াজ, আলু ও কচি চা পাতা মিশিয়ে বিশেষ এক ধরণের চাটনি তৈরি করে দুপুরের খাবার সেরে ফেলে। কেউবা চাল ভাজা ও লাল চা দিয়েই সাঙ্গ করেন দুপুরের খাবার।তারপর আবার কাজ শুরু করেন, যা চলতে থাকে বিকাল ৫ টা অবধি। তারপর আবার বাড়ির কাজ করতে হয়। এভাবেই শত কষ্টের মধ্যে কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন।
এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে এই নারীরা এক বিরাট ভূমিকা পালন করছেন, কিন্তু এদের ভাগ্যের উন্নতির জন্য সরকারপক্ষ থেকে কোন ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে চা শ্রমিকদের অভিযোগ।
অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নারী চা-শ্রমিকদের কাজ কাজ করতে হয়। বৃষ্টির দিনে তাদের ভোগান্তি আরো বেড়ে যায় । কর্মক্ষেত্রে পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির অভাবে নারী চা-শ্রমিকরা অনেক কঠিন রোগের শিকার হন। যেকারনে ৫০ বছরের একজন নারীকে ৮০ বছরেরও বেশি বয়সের মনে হয়। পারিবারিক জীবনে নানান দিক থেকে উপেক্ষিত হয় নারী চা শ্রমিকরা । পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয় না।
পারিবারিকভাবে তাদের কাজকে মূল্যায়ন করা হয় না। সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। সামাজিক বৈঠক, সভা-সমাবেশ ইত্যাদিতে তাদেরকে স্থান দেয়া হয় না।
রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও নারী চা-শ্রমিকের ভাগ্য-উন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসছে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনঃ আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও উপেক্ষিত হচ্ছেন আমাদের নারী চা-শ্রমিকরা। সারা বিশ্বব্যাপী নারী সমাজের উন্নয়নে যেসকল আইন-নীতি, উন্নয়ন-পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয় তাতে চা বাগানের নারী চা-শ্রমিকরা স্থান পান না।
তিনি আরো জানান, চা-বাগানগুলোতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের অবস্থা খুবই নাজুক। এখানে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলে রসিকতা। আমাদের নারীদের জটিল কিছু অসুখ আছে যার চিকিৎসা পাওয়া তো দূরের কথা এই অসুখ-বিসুখের কথা তাঁরা প্রকাশ করতে ও সংকোচবোধ করেন। অভিজ্ঞ বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী না থাকায় চা-বাগানগুলোতে মাতৃ হার দিন দিন বেড়েই চলেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর জন্য কয়েকবার আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছে। ১৯৬২ সালের টি প্লান্টেশন লেবার অডিন্যান্স এবং ১৯৭৭ সালের প্লান্টেশন রুলস-এ চা বাগান গুলোতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা মালিকের দায়িত্ব থাকলেও তা করা হচ্ছে না। যক্ষ্মা, টাইফয়েড , রক্তশুন্যতা, ডাইরিয়া ইত্যাদি রোগগুলো চা-শ্রমিকদের নিত্য দিনের সঙ্গী।
তিনি আরো বলেন, নারী চা-শ্রমিকদের জন্ম হয় শুধু চা-বাগানে কাজ করার জন্যই। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণকে অবাঞ্ছিত মনে করা হয়। যেকারনে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম জোরদার হচ্ছে না। নারী চা-শ্রমিকরা অসহায়ের মধ্যে অসহায় প্রান্তিকের মধ্যে আরো বেশি প্রান্তিক। সমাজ জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা প্রান্তিক অবস্থানে আছে।
নারী চা-শ্রমিকরা অসহায়ের মধ্যে অসহায় প্রান্তিকের মধ্যে আরো বেশি প্রান্তিক। সমাজ জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা প্রান্তিক অবস্থানে আছে।
সংবিধান বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭, ২৮(১), ২৮(৪) ধারাসহ নারী সংশ্লিষ্ট যেসকল ধারা রয়েছে তার কোন বাস্তব প্রয়োগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যেকারণে তাঁরা আরো বেশি উপেক্ষিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের নারীসমাজের উন্নয়নের জন্য সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি- ২০১১ ঘোষণা করে। এই নীতিতে দেশের সকল সেক্টরের নারীদের কথা বলা হলেও চা-শ্রমিক নারীদের নিয়ে একটি বাক্যও লেখা হয়। অথচ এই নারীরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
নারীদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করার জন্য ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বরে গৃহীত হয়
সিডও সনদ।