বাগেরহাট প্রতিনিধি: পদ না থাকলেও উপাধ্যক্ষ, বেতন তুলছেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের এবং একই সাথে কলেজ গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবেও নিয়মিত গভর্নিং বডির সভায় উপস্থিত থাকছেন। এমনকি অধ্যক্ষ পদ শূন্য থাকায় বেশ কয়েকবছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেনও তিনি। বহুমুখী ‘অবৈধ’ প্রতিভার অধিকারী ঐ শিক্ষকের নাম মোঃ হাসিবুর রহমান তিনি বাগেরহাট জেলার বেলায়েত হোসেন ডিগ্রি কলেজের কম্পিউটার বিষয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক।
শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ০১ মে, ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বেলায়েত হোসেন কলেজ (এইচএসসি) এমপিওভুক্ত হয় এবং ২০০৫ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রির অনুমোদন পায়। মোঃ হাসিবুর রহমান কলেজটিতে কম্পিউটার প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান ২০০৩ সালের । ০১ মে, ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে কলেজটি এমপিওভুক্ত হলে অন্যান্য শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হতে পারলেও মোঃ হাসিবুর রহমান এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। তার কম্পিউটার সনদ জাল বলে প্রতিয়মান হওয়ায় তিনি এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। তৎকালীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে তিনি জাল সনদ দিয়েই অন্যান্য শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির তিন মাস পর এমপিওভুক্ত হন। জাল কম্পিউটার সনদ দিয়ে শুধু এমপিওভুক্ত হয়েই শেষ নয়, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে কলেজটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি স্তরের অনুমোদন পেলেন তিনি প্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ পদ না থাকলেও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন মাত্র ১ বছর ১ মাস ১৭ দিনেরশিক্ষকতার অভিজ্ঞতা দিয়ে। ২০০৭ সালে টানা ১৮ মাস কারাবরণ করলেও তিনি এমপিওভুক্তির আট বছর পূর্তিতে প্রথম টাইমস্কেলে এই ১৮ মাস উপস্থিতি দেখিয়েছেন তিনি, বাগিয়েছেন জেলে থেকেও টাইমস্কেল।
জাল সনদের কারণে এমপিও আবেদন আটকে যায়
মোঃ হাসিবুর রহমান কম্পিউটার প্রভাষক হিসেবে ২৪ মার্চ, ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে কলেজটি যোগদান করেন। তৎকালীন সময়ে কম্পিউটার সনদ অর্জনের প্রতিষ্ঠান ছিল যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমী’ (নট্রামস) বগুড়া, বর্তমানে জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমী (নেকটার), বগুড়া। তবে মোঃ হাসিবুর রহমান কম্পিউটারের যে সনদ এমপিওভুক্তিতে দাখিল করেন তা এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে করা হয়নি। তিনি জাল সনদ দাখিল করে এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। বিষয়টি জাল ধরা পরলে একই সময়ে এমপিও’র আবেদন করে ০১ মে, ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে অন্যান্য শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হতে পারলেও মোঃ হাসিবুরের ফাইল রিজেক্ট হয়। তৎকালীন মাউশির কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে জাল সনদ দিয়েই তিনি এমপিওভুক্তির তিন মাস পরে এমপিও বাগিয়ে নেন। বর্তমানে তার জাল সনদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময়ে কলেজটিতে পরিদর্শনে গেলে বিষয়টি ধরা পড়ে যা এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
উপাধ্যক্ষ পদ না থাকলেও উপাধ্যক্ষ তিনি
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত (ডিগ্রি-স্নাতক) যেসব কলেজের কাম্য যোগ্যতা, কাম্য শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক রয়েছে এবং ডিগ্রি স্তর এমপিওভুক্ত সেসব প্রতিষ্ঠানে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের বিধান আছে। নন এমপিও ডিগ্রি স্তরে উপাধ্যক্ষ পদ না থাকলেও মোঃ হাসিবুর রহমান এই পদে নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছেন। বেলায়েত হোসেন কলেজ ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি স্তর অনুমোদন পায় এবং একই বছরে ১১ ফেব্রুয়ারি উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান তিনি।
১ বছর ১০ মাস ১৭ দিনের শিক্ষকতা যোগ্যতায় উপাধ্যক্ষ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী, উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেতেপ্রথম শ্রেনীর স্নাতক সম্মান ডিগ্রিসহ দ্বিতীয় শ্রেনীর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা দ্বিতীয় শ্রেনীর স্নাতক সম্মান ডিগ্রিসহ প্রথম শ্রেনীর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও ডিগ্রি কলেজ পর্যায়ে ন্যূনপক্ষে ৮ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। তবে এমপিওভুক্ত অভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এস.এস.সি অথবা এইচ.এস.সি পর্যায়ে একটি তৃতীয় বিভাগ গ্রহনযোগ্য হইবে।
উপাধ্যক্ষ পদের নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যবিবরণী ঘেটে দেখা যায়, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নিয়োগ পরিচালনা কমিটি নিয়োগের জন্য প্রাপ্ত আবেদন যাচাই-বাছাইকালে উপযুক্ত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থী না পেয়ে হাসিবুর রহমানকে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রদানের জন্য সুপারিশ করেন। তাছাড়া উক্ত কলেজটি ডিগ্রি পর্যায়ের এমপিওভুক্ত কলেজ নয় বিধায় উপাধ্যক্ষ পদে বাহির থেকে প্রার্থী না আসার কারণেও উপযুক্ত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থী না পেয়ে তাকে নিম্নপদের বেতন গ্রহণ সাপেক্ষে উপাধ্যক্ষ পদের দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ প্রদান করা হয় মর্মে নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যবিবরণীতে উল্লেখ্য করা হয়। নিয়োগের জন্য যে ব্যক্তি আবেদনেরই যোগ্য প্রার্থী নন অর্থ্যাৎ মোঃ হাসিবুর রহমান এমপিওভুক্ত হবার পর মাত্র ১ বছর ১০ মাস ১৭ দিন শিক্ষকতা অভিজ্ঞতায় উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিধি এবং এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো দুইটারই পরিপন্থি।
৪ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন
শুধু নিয়মবহির্ভূতভাবে সৃষ্ট পদ না থাকলেও উপাধ্যক্ষ পদ বাগিয়ে নিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি হাসিবুর রহমান টানা ৪ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন। কলেজটির প্রাক্তন অধ্যক্ষের অবসর গ্রহণের পর ২৪/১১/২০১৩ খ্রিঃ তারিখ থেকে প্রায় ৪ বছর বিধিবহির্ভুতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী যেহেতু কলেজটির উপাধ্যক্ষ পদ নেই সেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি বিধি অনুযায়ী, অধ্যক্ষের অবর্তমানে উপাধ্যক্ষ/ জেষ্ঠতম ০৫(পাঁচ) জন শিক্ষকের মধ্য হইতে যে কোন একজনকে দায়িত্ব প্রদান করতে হবে এবং সেই সঙ্গে পরবর্তী ০৬(ছয়) মাসের মধ্যে বিধি মোতাবেক অধ্যক্ষ নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানের এক বছরের মধ্যে নিয়মিত অধ্যক্ষ নিয়োগ দানে ব্যর্থ হইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বাক্ষরকৃত কাগজপত্র ও কার্যবিবরণী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্বীকৃত অথবা গৃহীত হবেনা। তবে জ্যেষ্ঠতার বিধি তো মানাই হয়নি যেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মেয়াদ এক বছর বেধে দেওয়া হয়েছে সেখানে হাসিবুর রহমান প্রায় চার বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
১৮ মাস জেলে থেকেও ৮ বছর পূর্তিতে পান টাইমস্কেল
নিয়ম অনুযায়ী, কোন এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষকের এমপিওভুক্তির ৮ বছর পূর্তি হলে তিনি প্রথম টাইমস্কেল পাবেন সে অনুযায়ী থাকে কলেজ অধ্যক্ষের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে হবে। মোঃ হাসিবুর রহমান ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি মামলায় টানা ১ বছর ৮ মাস কারাগারে থাকেন। কিন্তু কলেজটির নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, এক বছর ৮ মাস জেলে থেকেও অর্থ্যাৎ কলেজে অনুপস্থিত থেকে এবং বরখাস্ত থেকেও তিনি এই ১৮ মাস সময় বাদ না দিয়ে এমপিওভুক্তির ৮ বছর পূর্তিতেই প্রথম টাইমস্কেল বাগিয়ে নেন যা বিধিবহির্ভূত।
উপাধ্যক্ষ হয়েও শিক্ষক প্রতিনিধি
বেলায়েত হোসেন ডিগ্রি কলেজের চলমান গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি মোঃ হাসিবুর রহমান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ গভর্নিং বডি (সংশোধিত) ২০১৯ সংবিধি অনুযায়ী, একজন উপাধ্যক্ষ কলেজ গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি হতে পারেন না। কেননা অধ্যক্ষের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে উপাধ্যক্ষ দায়িত্ব পালন করেন। আর অধ্যক্ষ/ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ক্ষমতাবলে গভর্নিং বডির সদস্য সচিব। সে অনুযায়ী একজন সদস্য সচিব শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত হবার কোন ধরণের সুযোগ নেই। অথচ মোঃ হাসিবুর রহমান উপাধ্যক্ষ পদে থেকে একদিকে যেমন জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের বেতন তুলছেন অন্যদিকে তিনি গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি। অর্থ্যাৎ তিনি একই সাথে একই প্রতিষ্ঠানের তিন পদে আসীন রয়েছেন। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিধি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমপিও ও জনবল কাঠামোর পরিপন্থী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোঃ হাসিবুর রহমান মুঠোফোনে কল করলে তিনি বিস্তারিত শুনে মুঠোফোনে কোন কথা বলতে চাননি। বিস্তারিত সাক্ষাতে কথা বলতে চান। স্বপক্ষে কোন তথ্য কিংবা প্রমাণপত্র থাকলে ইমেইলে অথবা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বললেও তিনি স্বাক্ষাতে বিস্তারিত কথা বলতে চান।
বেলায়েত হোসেন ডিগ্র্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, প্রায় দুই যুগ আগে নিয়োগ পাওয়া। তার জাল সনদের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব তো আর আমার নয়। ডিআইয়ের সাম্প্রতিক পরিদর্শনকালে সব শিক্ষকের কাগজপত্র তো আপনার হাত ধরেই গিয়েছে সেখানে জাল সনদের বিষয়টি আপনার নজরে আসছে কি’না জিজ্ঞেস করলে বিষয়টি কর্তৃপক্ষ দেখবেন বলে জানান। উপাধ্যক্ষ থেকে কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি এবং পদ না থাকলেও উপাধ্যক্ষ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি গভর্নিং বডির সভাপতির দেখার এখতিয়ার। এবিষয়ে সভাপতি ভালো বলতে পারবেন জানিয়ে তিনি শিক্ষক হাসিবুরের উপস্থিতি এবং কলেজে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে স্বশরীরে হাজির থাকার প্রশংসা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বেলায়েত হোসেন ডিগ্র্রি কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ও বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এবং শহীদ নায়েক আব্দুল জব্বার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খান রেজাউল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
যা বলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, একজন উপাধ্যক্ষ গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা অধ্যক্ষের অনুপস্থিতে উপাধ্যক্ষই গভর্নিং বডির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, এমন অনেক কলেজ রয়েছে যেখানে পদ নেই অথচ সেই পদে দায়িত্বে আছেন এবং তা চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে সমস্যার সম্মুক্ষীন হতে হয়।
এ বিষয়ের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা জানান, বিষয়টি জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে দেখবেন। নীতিমালা বহির্ভূত কোন কিছু হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবেন।