মানজারুল ইসলাম মিলন স্টাফ রিপোর্টারঃপ্রমত্তা পদ্মানদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে অনবরত। শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার
কুন্ডেরচর, বাবুরচর ও ছিডারচর, চরাঞ্চল এলাকাসহ পদ্মানদীর দশ কিলোমিটারের মধ্যেই দিনরাত চলছে বালু উত্তোলন। এছাড়াও নড়িয়া উপজেলার চরআত্রা নওপাড়া ইউনিয়নের পদ্মারচর এলাকায় বালু ও মাটি কেঁটে বাল্কহেডে লোড করে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে পদ্মানদীর মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং এবং শরীয়তপুর জেলার জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলাসহ মাদারীপুর জেরার শিবচর সীমান্তবর্তী এলাকাতেও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল এই বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত আছে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায় ।
বর্তমানে জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানসহ ইউপি সদস্যরাও অবৈধ কাঁটার ড্রেজার দিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় তথ্যসূত্র জানা যায়, সিটারচর এলাকার স্থানীয়দের অভিযোগ ইউপি চেয়ারম্যান আক্তার বেপারী এবং সংরক্ষিত মহিলা মেম্বারের স্বামী ও বিভিন্ন ওয়ার্ড মেম্বাররা মিলে অবৈধ কাঁটার ড্রেজার দিয়ে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে।
বালু উত্তোলনকারীর সাথে যারা জড়িত মেম্বারগণ সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার ৪.৫.৬ নং ওয়াড এর স্বামী মোস্তফা খাঁ। ৫ নং ওয়াড মেম্বার ইমাম খাঁ এবং ১ নং ওয়াড সাহেদ আলী মল্লিকসহ মেম্বার জামাল খাঁ জড়িত রয়েছে সেইসাথে অন্যনরা হলেন লতিফ মল্লিক, নজরুল মল্লিক, বোরহান মল্লিক, মনির খাঁ, জয়তু খাঁ, দেলোয়ার খাঁ ও বাদশাহ বেপারীদের নামে অভিযোগ উঠেছে।
কুন্ডেরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তার বেপারী বলেন আমি বরাবরই ড্রেজারের বিরুদ্ধে নদীতে অভিযান পরিচালনা হোক ড্রেজার বন্ধ হোক।
কুন্ডেরচর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত মল্লিক বলেন পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজিং করে বালু উত্তোলন করতে সাহায্য করে নৌ-পুলিশ। মোটা অংকের টাকা খেয়ে নদীতে ড্রেজিং করার সুযোগ করে দেয় তিনি আরও বলেন নৌ-পুলিশের নৈতিকতা নেই।
বর্তমানে পদ্মানদীতে অর্ধশত ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কাজে সক্রিয় রয়েছে। পদ্মাসেতু সংলগ্নে পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের পাইনপাড়া এলাকার নদীর নতুন একটি চ্যানেলের মাধ্যমে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ড্রেজার দ্বারা উত্তোলনকৃত বালু বাল্কহেডে ভরে নিয়ে যাওয়া হয় বিক্রির উদ্দেশ্যে। প্রতি ঘনফুট বালু পাইকারি বিক্রি করা হয় ৮০/৯০ পয়সা দরে। আর খননের জন্য ড্রেজার মালিক প্রতি ঘনফুটে পান ৬০ পয়সা। খুচরা বাজারে এই বালু বিক্রি হয় প্রতি ঘনফুট ১০/১২ টাকা দরে বিভিন্ন জায়গায়।
ড্রেজারগুলো নারায়ণগঞ্জ,বরিশাল, চাঁদপুর, লক্ষীপুর, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়ায় এনে নদীতে বালু উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন সময় অভিযানে শ্রমিকেরা আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে বালু বিক্রয়ের মূল হোতারা এবং ড্রেজার চক্রের মালিকরা।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে পদ্মানদীতে অভিযান চালিয়ে ড্রেজার জব্দ, জড়িতদের আটক এবং জরিমানা করা আটককৃত আসামি চালান হলেও থেমে নেই সেখানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ড্রেজার দিয়ে উত্তোলনকৃত বালু বাল্কহেড দিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয় এসকল বালু। বিভিন্ন এলাকায় ও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় পদ্মা নদীর চর কেটে নেওয়া অবৈধ এই বালু এবং মাটি।
নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির এবং জাজিরা উপজেলা মাঝীরঘাট নৌ পুলিশ ফাঁড়ির আওতাভুক্ত থাকলেও নামে মাত্র মাঝে মধ্যে তাদের অভিযানের খবর পাওয়া যায়। এছাড়া, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ আদায় করে থাকে বলেও নৌপুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বাল্কহেড থেকেও চাঁদা আসে নৌ-পুলিশের হাতে। এছাড়াও প্রশাসনের ‘অভিযান হবে’ এমন খবরও নৌ-পুলিশের মাধ্যমেই বালু উত্তোলনকারীদের কানে পৌঁছে যায় বলে একটি সূত্রে জানা যায় ।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারি চক্রের সদস্যের খবর পাওয়া গেছে। সদস্যের মধ্যে জাজিরা উপজেলা কর্মরত একজন সাংবাদিকের নাম উঠেছে । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে জাজিরার স্থানীয় প্রভাবশালী কতিপয় ব্যক্তি পদ্মানদী থেকে বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত ছিল। সে সময় রাতের বেলা এই সকল ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। বিশেষ করে পদ্মা নদীবর্তী এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই কাজে জড়িত আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ব্যক্তি বিশেষের পরিবর্তন ঘটলেও নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের চাপে সাময়িক বন্ধ থাকলেও সুযোগ পেলেই শুরু হয় বালু উত্তোলন। বর্তমানে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আত্মগোপনে থাকলেও আরেকটি মহল বালু উত্তোলনের মহোৎসবে যুক্ত হয়েছে। জাজিরা এবং নড়িয়া এর কমপক্ষে অর্ধশত ড্রেজার বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
কুন্ডেরচর এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি সাংবাদিকদের জানান, জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নের পদ্মানদীতে জেগে উঠা বাবুরচরের মাটি ড্রেজারের মাধ্যমে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। নতুন জেগে উঠা চর ফসল উৎপাদনের উপযোগী হলেও বালুখেকোদের কবলে পরে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে চরে চাষ করা ফসলসহ জমির মাটি কেটে বিক্রি করে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিলেও তেমন কোনো প্রতিকার হয়নি বলেও জানা গেছে।
এদিকে, উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে নড়িয়া উপজেলা সুরেশ্বর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ উপ-পরিদর্শক বলেন, গত মাসে পদ্মানদী থেকে আমরা বেশ কয়েকটি বাল্কহেড ও ড্রেজার জব্দ করেছি। আমরা খবর পেলেই সাথে সাথে নদীতে অভিযান পরিচালনা করি। তাছাড়া সাধারণ মানুষজন নৌ-পুলিশ সম্পর্কে ওরকম একটু বলেই ।
জাজিরা উপজেলা মাঝীরঘাট নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা অনেক কষ্ট করে নদীতে অভিযান চালাচ্ছি। গত কয়েক মাসে অনেক ড্রেজার আটক করা হয়েছে । পদ্মা নদীর কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ছিটারচর কলমিরচর এলাকায় ড্রেজারগুলো চলে। আমাদের ব্যবহৃত নৌযান নষ্ট হয়ে পড়ে আছে কয়েক মাস যাবত। পদ্মা নদীতে অবৈধ ড্রেজারিং বা ডাকাতি হওয়ার খবর পেলে। আমাদের নৌকা অথবা টলারের মাধ্যমে পদ্মা নদীতে অভিযান পরিচালনা করতে হয়।
নৌ-পুলিশ চাঁদপুর জোনের সার্কেল (এএসপি) মোঃ ইমতিয়াজ বলেন আমরা পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি এবং নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জদের আমি অবগত করেছি দ্রুত নদীতে ড্রেজারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
জাজিরা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাদিয়া বিনতে সোলয়ামান বলেন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা কার্টার ড্রেজারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন। যৌথবাহিনী সাথে নিয়ে শীঘ্রই আমরা বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবো অভিযান অব্যাহত থাকবে।
জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম লুনা বলেন, পদ্মা নদীতে বালু উত্তোলনকারী সবগুলো ড্রেজারই অবৈধ আমরা অভিযান পরিচালনা করি। গত ২ সপ্তাহে বেশ কয়েকটি অবৈধ ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে। পদ্মায় বালু উত্তোলন বন্ধ করতে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।