নিজস্ব প্রতিনিধিঃ থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে আইন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও কিছু ভাবনা এ ব্যাপারেও আইন করা যেতেই পারে। কিন্তু এরপরও যদি কোনও বাহক অপর একজন বাহককে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে সেই বিয়ে বন্ধ করা- এ ধরনের আইন কোনও সভ্য দেশে আছে বলে জানা নেই।
এ বছরেরই জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়ামে থ্যালাসেমিয়া শীর্ষক একটি আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, একাধিক মন্ত্রী এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও উপস্থিত ছিলেন। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পড়ে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, এ আলোচনা সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল – থ্যালাসেমিয়া নামক ভয়াবহ অসুস্থতার হাত থেকে দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে রক্ষা করার কৌশল সম্পর্কে মতবিনিময় এবং পদ্ধতি নির্ধারণ করা।
উদ্দেশ্য যে মহৎ এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু পুরো সংবাদ পড়ে আমি উৎসাহিত হবার পরিবর্তে আশঙ্কিত হয়েছি বেশি। থ্যালাসেমিয়া একটি জটিল জন্মগত জিন-ত্রুটি জনিত রোগ – যা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুঃখজনক হচ্ছে যে, এ রোগটা নিয়ে যেমন জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে, তেমনি চিকিৎসক এবং রোগীদের মাঝেও সুস্পষ্ট ধারণার প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যাদি উপস্থাপনের কারণে যদি নীতি নির্ধারকরা কোন ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হন তাহলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে- এ আশঙ্কায় কিছু কথা সবার জ্ঞাতার্থে বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
ওইদিনের আলোচনায় এসেছে- থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে বিয়ে পড়ানোর আগে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ বাধ্যতাকরণে আইন পাস করতে হবে। আশঙ্কার কারণটা এখানেই। কী আইন পাস করাতে হবে? রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার আইন- নাকি দুইজন বাহকের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করার আইন? কারণ যে সমস্ত উন্নত দেশে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা হয়েছে, সেসব দেশে কী ধরনের আইন আছে- ব্যাপারটা বিস্তারিত না জেনে এমন আইনও পাস হতে পারে যেটা জনহিতিকর না হয়ে জনদুর্ভোগের কারণও হতে পারে।
আমরা সবাই জানি, দেশের অনেক ল্যাবরেটরি মাঝে মাঝে ভুল রিপোর্ট দেয়- যার ফলে রোগীরা দারুণ ভোগান্তি ও ক্ষতির সম্মুখীন হন। অথচ এই ভুল রিপোর্ট এর জন্য কোন শাস্তির ব্যবস্থা নেই। আমার এ ধরনের ঘটনাও জানা আছে যে থ্যালাসেমিয়া বাহক মা-বাবাকে প্রিনেটাল টেস্ট (গর্ভস্থিত ভ্রুণের জিনগত ত্রুটি নির্ধারণের পরীক্ষা) করে বলা হয়েছে যে, তাদের ভবিষ্যৎ সন্তান থ্যালাসেমিয়া মুক্ত হবে। অথচ সন্তানটি পরে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু হিসেবেই জন্ম নিয়েছে। টেস্টটি ছিল জটিল এবং ব্যয়বহুল। থ্যালাসেমিয়া টেস্ট বাধ্যতামূলক করার আগে অবশ্যই এ নিশ্চয়তাও রোগীদেরকে দিতে হবে যে টেস্টের রিপোর্ট ভুল হবে না। ভুল হলে তার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকবে। ভুল টেস্ট যারা করবে তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে এবং এগুলোর নিশ্চয়তা বিধান করার পরই টেস্ট করাটা বাধ্যতামূলক করা যায়।
থ্যালাসেমিয়া সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ব্যাপারে একটা কথা বলা আবশ্যক যে, রক্ত পরীক্ষা হয়তো বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, কিন্তু বিয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পাত্র এবং পাত্রীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার আইন করা যায় না। এটা ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং পুরুষ যখন পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারবেন যে, তারা থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক, তখন তাদেরকে পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং করা অতীব জরুরী।
এ ব্যাপারেও আইন করা যেতেই পারে। কিন্তু এরপরও যদি কোনও বাহক অপর একজন বাহককে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে সেই বিয়ে বন্ধ করা- এ ধরনের আইন কোনও সভ্য দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। জনমনে যে সমস্ত বিভ্রান্তিমূলক ধারণা আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, রোগী এবং বাহকের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্যটা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারা।
থ্যালাসেমিয়া বাহকরা সম্পূর্ণ সুস্থ এবং এদেরকে রোগীদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া বাহকের সংখ্যা জনসাধারণের শতকরা ১০ থেকে ১২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি মানুষ। আর থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার শিশু জন্ম নেয়। বাহকরা যদিও সম্পূর্ণ সুস্থ, এক বাহক যদি অপর এক বাহককে বিয়ে করে তাহলে তাদের সন্তানদের মধ্যে কারো কারো থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে নানা প্রকারভেদ আছে- যেমন কোন কোন রোগীকে প্রতিমাসে দুইবার রক্ত নিতে হয়, আবার কোনও কোনও রোগীকে বছরে মাত্র দু-একবার রক্ত নিতে হয়। একজন বাহক যদি আরেকজন স্বাভাবিক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন অর্থাৎ যিনি বাহক নন- তাকে বিয়ে করেন, তাহলে তাদের সন্তানদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া হবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। যদিও জনসাধারণের অনেকের মধ্যে, এমন কি অনেক চিকিৎসকেরও এমন ভুল ধারণা আছে যে, এ ধরনের যুগলেরও কোন কোন সন্তান হয়তো থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
আলোচনায় এসেছে, মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হলে হিমোগ্লোবিন ও থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং টেস্ট করা যাবে। কথাটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু বর্তমানে কোথাও আসলে এত অল্প টাকায় থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং হয় না। শুধু তাই নয়, ঢাকা এবং বড় বড় শহরগুলোর বাইরে অধিকাংশ অঞ্চলেই এই স্ক্রিনিং টেস্ট আদৌ হয় না। সুতরাং যে কোন ধরনের আইন করতে হলে জনসাধারণের কাছে হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস বা স্ক্রিনিং টেস্টের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
ওই আলোচনা সভায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ও চিকিৎসক সরফুদ্দিন আহমেদ সবাইকে অবহিত জানিয়েছেন যে, সরকার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার মাধ্যমে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীদের ও ভর্তির আগে থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং টেস্ট করা হবে। সরকারের এই প্রকল্পের আরো বিস্তারিত জানলে আমরা খুশি হব। নিঃসন্দেহে থ্যালাসেমিয়া কমিউনিটির জন্য তথা পুরো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবীদের জন্য এটা একটা সুখবর।