স্টাফ রিপোর্টার আত্রাই নওগাঁঃ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মবার্ষিকী আগামীকাল রোববার (২৫ বৈশাখ)। তার এই জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে সকল জরা-জীর্ণকে পিছনে ফেলে নতুন বছরের আগমনের সঙ্গে বিশ্বকবির জন্মকে নতুন চিত্তে ভাবার জন্য ধুয়ে-মুছে প্রস্তুত করা হচ্ছে নওগাঁর পতিসরের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়ি। সাজানো হচ্ছে অপরূপ বর্ণিল সাজে। পতিসর এখন উৎসবমুখর। দূরদূরান্ত থেকে ইতিমধ্যে আসতে শুরু করেছেন লেখক, গবেষক ও রবিভক্ত-অনুরাগীরা। করোনার কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে এবারও তার নিজস্ব জমিদারি তার স্মৃতি বিজড়িত নওগাঁর পতিসর কাছারি বাড়ি প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপী নানা উৎসবের। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় নওগাঁ জেলা প্রশাসন এর আয়োজন করছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের। এছাড়াও আলোচক হিসাবে উপস্থিত থাকবেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রবীন্দ্র গবেষকরা। দেবেন্দ্র মঞ্চে দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, নাটক, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রবীন্দ্র মেলা। প্রতিবছর তার এই জন্মবার্ষিকীতে পতিসরে নামে রবীন্দ্রভক্তের ঢল। পরিণত হয় মানুষের মহামিলন মেলায়। সরকারিভাবে একদিনের কর্মসূচি নিলেও এ মিলনমেলা চলে প্রায় পুরো সপ্তাহজুড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে কবিভক্তরা ছুটে আসেন তাদের প্রিয় কবির পতিসর কাছারি বাড়ি প্রাঙ্গণে। স্মৃতিচারণে লিপ্ত হন তারা। নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার ও আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ রেল স্টেশন হতে সড়ক পথে ১৮ কিলোমিটার দূরে কাছারি বাড়িটি অবস্থিত। সবুজ সমারোহে ছেয়ে থাকা এক ছোট্ট গ্রামের নাম পতিসর। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ, তালগাছের সারি, বটের ছায়া, নদীর হাঁটুজলে কিশোরের দুরন্তপনার পটচিত্র পেরোলেই চোখে পড়বে নাগর নদের তীরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পতিসর কুঠিবাড়ি। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরও দুটি কুঠি বাড়ি রয়েছে তার মধ্যে পতিসরেরটি বেশ গোছানো। এটি বাংলাদেশের অন্যতম পুরাকীর্তি ও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত একটি স্থান। জানা যায়, ১৮৩০ সালে বিশ্বকবির পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এ কালীগ্রাম পরগনা কিনে পারিবারিক জমিদারির অংশে অন্তর্ভুক্ত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে প্রথম পদচারণ করেন ১৮৯১ সালের ১৬ জানুয়ারি। জমিদারি দেখাশোনার জন্য এলেও প্রকৃতি ও মানবপ্রেমী কবি অবহেলিত পতিসর এলাকার মানুষের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাসহ অনেক জনহৈতিষী কাজ করেন। এখানকার কৃষকের কল্যাণে নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ৮ হাজার টাকা দিয়ে তিনি একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। কবির সাহিত্য সৃষ্টির একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে পতিসর। ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবারের মতো পতিসরে আসেন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে পতিসর কুঠিবাড়ি। কুঠিবাড়ি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯০ সালে কুঠিবাড়ির দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৮৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর কালীগ্রাম পরগনা জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করেন। পতিসর কালীগ্রাম পরগনার সদর দফতর। নওগাঁ, বগুড়া ও নাটোর জেলার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে কালীগ্রাম পরগনা গঠিত। এর আয়তন ছিল ২৩০ বর্গমাইল। রাতোয়াল আর ভান্ডারগ্রাম আরও দু’টি সাব কাছারি ছিল। রাতোয়াল পতিসর থেকে ১০ কিলোমিটার আর ভান্ডারগ্রাম ২০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। কালীগ্রাম পরগনার সীমানা ছিল উত্তরে মালশন আদমদিঘী, দক্ষিণে আত্রাই নদী, পূর্বে নাগর নদ, পশ্চিম তীর আর পশ্চিমে নাগর বিধৌত বাঁকা-কাশিয়াবাড়ি গ্রাম। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বাংলাদেশে ছিল তিনটি জমিদারি। পতিসরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে কালীগ্রামের সহজ-সরল প্রজা সাধারণের ভক্তি ও শ্রদ্ধা। এখানে এসে তিনি কৃষকদের খুব কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে কৃষকের অর্থনীতি সম্পর্ককে ভালো ধারণা জন্মেছিল। তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তা-ঘাট শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য বিমোচনসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেন। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পরগনাকে তিনটি বিভাগে ভাগ করেন। কালীগ্রাম ‘হিতৈষী সভা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে পতিসর, রাতোয়াল ও কামতা তিনটি বিভাগে তিনটি মধ্য ইংরেজি (এমই) স্কুল ও পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে একটি হাইস্কুল স্থাপন করেন। স্কুলের ভবন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ এস্টেট থেকে বহন করা হতো। পতিসরে অবস্থিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল পতিসর এম ই স্কুল। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। ১৯১৩ সালে রাতোয়াল বিভাগে একটি বিদ্যালয় এবং কামতায় আরও একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই পতিসরে বসে কবি রচনা করেছেন কাব্য নাটিকা, বিদায় অভিশাপ, গোরা ও ঘরে বাহিরে। ছোট গল্পের মধ্যে প্রতিহিংসা, ঠাকুরদা ও ভারতবাসী প্রবন্ধ। গানের মধ্যে যেমন “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা,তুমি আমার নিভৃত সাধনা,” বধূ মিছে রাগ করোনা সহ অনেক গান। দুই বিঘা জমি, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ… ইত্যাদি কবিতা। সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে কবির দেয়াল ঘড়ি, লোহার সিন্দুক, খাট, টি-টেবিল, টি-পট, আয়না, নাগর বোটের এ্যাংকর, ট্রাক্টরের ভগ্নাংশ, কবির স্নানের বাথটাব, কবির বিভিন্ন বয়সের ছবি, কবির স্বহস্তে লিখিত ৬ পৃষ্ঠার চিঠিসহ নানান সামগ্রী।
এ বিষয়ে নওগাঁর বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক কবি আতাউল হক সিদ্দিকীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, পতিসর কুঠিবাড়ি যে পরগনায় অবস্থিত সেটাই কবির পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কালীগ্রাম পরগনা এবং এটাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব জমিদারি। শাহজাদপুর ও শিলাইদহের জমিদারি ছিল কবির অন্য ভাইদের। কবি যেহেতু এ অঞ্চলে বেশি আসতেন তাই তাকেই সব জমিদারি দেখাশোনা করতে হতো। আতাউল হক সিদ্দিকী আরও জানান, ১৮৯১ সালের