জেলা ব্যুরো সিরাজগঞ্জঃ আজ শবে বরাত। মনে পড়ছে একসময় এদেশে কী ভাবগাম্ভীর্যের সাথেই না উদযাপিত হতো এই রাতটি! ছেলেবেলায় গ্রামের দিনগুলোর কথাই বেশি করে মনে পড়ছে। গ্রামে তখন আজকের মত আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলো না। দু’একটি পরিবার ছাড়া প্রায় সবাই ছিলো মূলত দরিদ্র। সে সময় আজকের মত উচ্চ ফলনশীল ধান, উন্নত সেচ ব্যবস্থা, সার, কীটনাশক ছিলো না। ধানের ফলন ছিলো আজকের তুলনায় ৫ ভাগের এক ভাগ- নাজিরশাল, আউস, আমন, মাটাগড়া, সসশড়া, পাটজাগ, কাটারী, নাজিরশাল হলে বিঘায় ৫ মন, ঢ্যাপো, লাঠিশাল বড়জোর ১০। মাঠে যাদের চাষের জমি ছিলো, গোয়ালে গরু ছিলো, ঠিকমতো আবাদ না হলে তাদেরকেও সংকটে পড়তে হতো। তবু বরাতের রাতে বিকেল থেকেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতো কাসার থালায় হালুয়া রুটি। পরিমাণ হয়তো বেশি নয়, আয়োজনও সামান্য- কয়টা চালের রুটি আর খেজুরের গুড় ও কুশালের গুড় দিয়ে বানানো হালুয়া, কিন্তু পাশের বাড়িতে রুটির থালা যাবেই যাবে। গ্রামে বরাতের রাতের নামই ছিলো রুটি। আজ এতদিন পরে, এতটা পথ পেরিয়ে এসে গ্রামের সেই ‘রুটি’র জন্য মনটা হাহাকার করে উঠছে।
বরাতের রাতটি পূর্ণচন্দ্রের। রাতভর বন্ধুবান্ধবদের সাথে দল বেঁধে এক মসজিদ থেকে আর এক মসজিদে ঘুরেঘুরে নামাজ পড়তাম। ইবাদতের ফাকে খাওয়াদাওয়া, হাসি ঠাট্টা, বাদরামিও কিছু কম হতো না। তবু একবারে ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে ফিরতাম অন্তরে দারুন এক প্রশান্তি নিয়ে।
বরাতের রাত নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। ইসলামি পন্ডিতগনও এতে শামিল আছেন। বিতর্কটি শুধু এদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী, এর জেরে মাঝখানে বেশ কয়েক বছর বরাতের রাতের এবাদত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছিলাম। লক্ষ্য করছি গত কয়েক বছরে এই আলোচনাটিতে একটা স্বাস্থ্যকর আবহের সূচনা হয়েছে। এবছর এটি বেশ জোরালো। কথা মূলত দু’টি; প্রথমত যদি ধরেও নেয়া হয় যে বরাতের রাতের আলাদা মর্যাদা নেই, তবু যে কোন রাতেই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবাদতে মশগুল হবার মধ্যে খারাপ কিছু নেই; দ্বিতীয়ত, বরাত একটি ইসলামি সংস্কৃতি, একটি ঐতিহ্য। শবে বরাত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সাথে, প্রতিবেশীর সাথে দায়িত্ববোধের, ভালোবাসার সম্পর্ক নবায়নের একটি মাধ্যম। সে হিসেবেও এটি অনুমোদনযোগ্যই শুধু নয়, অতীব প্রয়োজনীয়। ‘মিসকিনকে খাবার খাওয়ানো’র কথা পবিত্র কোরানে বারবার এসেছে। বরাতের ঐতিহ্যটিকে সে দৃষ্টিকোন থেকে দেখলেই বা ক্ষতি কী!
সাধারণ মানুষ হিসেবে মাসলা মাসায়েলের গূঢ় আলোচনায় যাবার এখতিয়ার নেই জানি, তবু এই দু’টি বিষয় বিবেচনায় নিলেও শবে বরাতের উপলক্ষটি আমার কাছে খুবই প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। মহান আল্লাহ, যিনি হৃদয়ের খবর রাখেন- আমাদের উদ্দেশ্য, আমাদের ভাবনা, আমাদের প্রচেষ্টাকে কবুল করুন!
শবে বরাত, ২০২২