
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক কার্যক্রম আবারও জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ সর্বোচ্চ সাজা- অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে। প্রসিকিউশন পক্ষের দাবি, আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো গুরুতর ও গভীর, যা আইনের আলোকে সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধের মধ্যে পড়ে।
এই দাবি শুধু একটি মামলার নয়; এটি বাংলাদেশের বিচার, রাজনীতি ও ন্যায়বিচারের কাঠামো নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ও ভাবনার জন্ম দিয়েছে।
‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩’-এর অধীনে গঠিত এই ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। ২০১০ সালে আদালতটি পুনর্গঠন হলে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া।
আইনের ২০ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে- অপরাধ প্রমাণিত হলে আদালত মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনসহ যেকোনো শাস্তি দিতে পারবে। অর্থাৎ দণ্ড নির্ধারণ সম্পূর্ণভাবে আদালতের বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।
প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীমের ভাষায়, “অপরাধের গভীরতা ও সম্পৃক্ততা অনুযায়ী আদালত মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা অন্য শাস্তি দিতে পারেন।”
এই বক্তব্যেই বোঝা যায়, প্রসিকিউশন পক্ষ শেখ হাসিনার মামলাটিকে ‘গুরুতরতম অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আইনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন ট্রাইব্যুনাল কেবল ব্যক্তিকে নয়, রাজনৈতিক দল, অঙ্গসংগঠন বা সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীকেও বিচারের আওতায় আনতে পারে।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে আদালত সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত, নিষিদ্ধ বা সম্পদ জব্দ করার ক্ষমতা পেয়েছে। একই সঙ্গে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টনের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতাও যুক্ত হয়েছে।
প্রসিকিউটর তামীম জানান, শেখ হাসিনার মামলায় তাঁরা এই ধারা অনুযায়ী সম্পদ বাজেয়াপ্তের আবেদনও করেছেন।
এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় একটি নতুন দৃষ্টান্ত হতে পারে, যেখানে ন্যায়বিচারের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
তবে শেখ হাসিনার মামলাটি শুধু আইনগত নয়, রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে এমন একটি মামলায় সর্বোচ্চ সাজা চাওয়া- এটি নিঃসন্দেহে দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক মহলে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে সবসময়ই রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে। কেউ বলেছেন, এটি ন্যায়বিচারের প্রতীক; কেউ বলেছেন, এটি রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার।
এবারও সেই প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে- এই মামলা কি কেবল ন্যায়বিচারের অনুসন্ধান, নাকি রাজনীতির নতুন ভারসাম্য রচনার প্রয়াস?
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের এই আইন বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্র-প্রণীত যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আইন, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সনদের আগেই প্রণীত। এই আইনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ প্রথমবার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল।
অতএব, শেখ হাসিনার মামলাটি শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং এই আইনের ইতিহাস ও প্রয়োগের ধারাবাহিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও বটে।
ন্যায়বিচার তখনই পূর্ণতা পায়, যখন সেটি হয় আইনের শাসনের ওপর নির্ভরশীল এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। শেখ হাসিনার মামলায় আদালত যদি নিরপেক্ষভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ যাচাই করে রায় দেয়, তবে এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা আরও বাড়াবে।
অন্যদিকে, যদি রায়কে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়, তবে সেটি আইনের শাসনের ধারণাকে দুর্বল করবে।
এই ভারসাম্যই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- বিচার যেন হয়, তবে বিচার যেন ন্যায়ের পথেই হয়।
শেখ হাসিনার মামলায় প্রসিকিউশন সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছে। আদালত এখন আইনি প্রমাণ ও সাক্ষ্যের আলোকে সিদ্ধান্ত নেবে। এই রায়ের প্রভাব শুধু একজন আসামির ওপর নয়, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি- সব ক্ষেত্রেই পড়বে।
বাংলাদেশ আজ ন্যায়বিচারের এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই রায় প্রমাণ করবে- দেশটি আইন ও ন্যায়ের পথে কতটা দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।
লায়ন ড. এ জেড এম মাইনুল ইসলাম পলাশ
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক