আলমগীর হোসেন সাগরস্টাফ রিপোর্টার: সৌদি আরবের রিয়াদ শহরের আম্বারিয়া এলাকায় রুম হিটার বিস্ফোরণ হয়ে শ্রীপুরের গোসিঙ্গা ইউনিয়নের দুই বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক মারা গেছেন বলে জানা গেছে। নিহতের স্বজনেরা গতকাল বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) বিষয়টি জানতে পারে। এর আগে সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতের কোনো এক সময়ে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন—মাসুদুল হাসান (২৪) এবং মো. মাসুম (৪০)। তাঁরা স্থানীয় একটি রিসোর্টে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন এবং একসঙ্গে থাকতেন।
নিহত মাসুমের মা পিয়ারা খাতুন বলেন, ‘সাতমাস আগে স্থানীয় জয়নাল আবেদীনের মেয়ের জামাই মাজাহারুলের মাধ্যমে সৌদি আরবে পাঠানো হয় ছেলেকে। সাত মাসের মধ্যে ছয় মাসই কোনো কাজ পায়নি আমার ছেলে। খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে দিনপাত করতে হয়েছে। স্থানীয় দালাল কথামতো কাজ দেয়নি। এক মাসে শুধুমাত্র ২৩ হাজার টাকা পাঠিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ভাতিজা রিয়াদ শহরে থাকে। দুদিন যাবৎ আমার ছেলের সঙ্গে তার কথাবার্তা হয় না। মোবাইল ফোন বন্ধ। এরপর আমার ভাতিজা ছেলের খোঁজ খবর নিতে ছেলের বাসায় গিয়ে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ পায়। এরপর ঘরের ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পুলিশে ফোন করে। পুলিশ এসে দরজা খুলে দেখে তাদের দুজনের মরদেহ পড়ে রয়েছে ঘরের মেঝেতে। এরপর বুধবার সকালে ফোন করে ছেলের মৃত্যুর বিষয়টি জানায় আমার ভাতিজা। একমাত্র ছেলের উপার্জন দিয়ে চলতো আমার সংসার।’
নিহত মাসুমের স্ত্রী রত্না আক্তার বলেন, ‘খবরটি শোনার পর থেকে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি। আমার সংসার কে দেখবে। আমার ৩ বছর বয়সী আলিদ নামে একটি প্রতিবন্ধী ছেলে। ১৩ বছর বয়সী একটি কন্যা রয়েছে। আমার বৃদ্ধা শাশুড়ি আমার সন্তানদের কে দিবে ভরণপোষণ। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। একদিকে এনজিও ঋণের কিস্তি, অপরদিকে সন্তানদের ভরণপোষণের চিন্তায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।’
নিহত মাসুদুল হাসানের বড় বোন মিনারা বলেন, ‘আমার ভাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। সর্বশেষ সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ভিডিও কলে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলে। হঠাৎ করে সৌদি আরবে থাকা একজন ফোন করে জানায় ভাই মারা গেছে। এরপর কীভাবে মারা গেছে জানতে চাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে সবকিছু দেখায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি আরবের পুলিশ দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করে। তারা ভিডিওতে বিষয়টি দেখতে পাই। কাজ শেষে বাসায় এসে ক্লান্ত শরীরে রুম হিটার চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। রুম হিটারের নির্দিষ্ট সময় পার হলেও হিটার বন্ধ না করার কারণে বিস্ফোরণে এই দুর্ঘটনা হয়েছে। রুমের ভেতর আটকে আমার ভাইসহ পাশের গ্রামের আরেকজন মারা গেছে।’
নিহত মাসুদুল হাসানের ছোট ভাই রিফাত হাসান বলেন, ‘বড় ভাই প্রায় তিন বছর যাবৎ সৌদি আরবে রয়েছেন। বিয়ের ২০ দিন পর বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। গতকাল সোমবার রাতে ভাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে। বুধবার সকালে মৃত্যু খবর পাই। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ছুটিতে বাড়িতে আসার কথা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘ভাই সর্বশেষ তো দেশে আসছে কিন্তু লাশ হয়ে। ভাই সৌদি আরবের রিয়াদ শহরের আম্বারিয়া এলাকায় একটি রিসোর্টে শ্রমিকের কাজ করতেন। প্রথম দুবছর কষ্ট হলেও গত এক বছর টাকার মুখ দেখে।
নিহত মাসুদুলের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, ‘বিয়ের ২০ দিন পর স্বামী সৌদি আরবে পাড়ি জমান। মোবাইল ফোনে প্রায় প্রতিদিন কথা হতো। গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার সঙ্গে কথা হয়। জানিয়েছেন তিনি খুবই ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়বেন। এটাই স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা। এরপর মঙ্গলবার কোনো কথা হয়নি। আমি চেষ্টা করেও ফোনে কল করে পায়নি। মনে করছি কাজের চাপ। কিন্তু এটা তো বুঝতে পারিনি চিরদিনের জন্য স্বামী চলে গেছে।’
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব আহমেদ বলেন, ‘সৌদি আরবে দুই শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি স্বজনদের মাধ্যমে অবগত হয়েছি। মরদেহ দেশে আনতে প্রশাসনের পক্ষে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’