
মোঃ বাবুল ময়মনসিংহ জেলা ব্যুরো প্রধান
জ্ঞান, মমতা আর মানবিকতার বাতিঘরকে বিদায় জানাল প্রজন্মের পর প্রজন্ম
শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়—এটি এক আজীবনের সাধনা, এক আত্মনিবেদিত যাত্রা।
যে মানুষ সারাজীবন নিজেকে বিলিয়ে দেন অন্যের আলোকিত জীবনের জন্য, তিনিই প্রকৃত শিক্ষক।
তেমনই একজন আলোকবর্তিকা ময়মনসিংহ সদরের সাহেব কাচারী লেতু মন্ডল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রিয় শিক্ষক মোঃ আনিসুর রহমান।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি শুধু পাঠ্যবই শেখাননি—
তিনি শিখিয়েছেন মানুষ হওয়ার শিক্ষা, শিখিয়েছেন ভালোবাসা, সম্মান আর মানবিকতার অর্থ।
বৃহস্পতিবার ছিল তাঁর বিদায়ের দিন।
কিন্তু সেটি কেবল এক কর্মজীবনের সমাপ্তি নয়—
বরং এক প্রজন্মের হৃদয়ে গেঁথে থাকা কৃতজ্ঞতার উৎসব।
সকালের প্রথম আলোয় যখন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ জেগে উঠছে,
তখন যেন বাতাসেও মিশে ছিল অদ্ভুত এক আবেগ।
প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা হাতে ফুল, ব্যানার ও ক্রেস্ট নিয়ে ভিড় জমিয়েছেন বিদ্যালয় চত্বরে।
কারো চোখে উচ্ছ্বাস, কারো চোখে অশ্রু—
সব মিলিয়ে এক সোনালি-বেদনাময় সকাল।
মঞ্চে একে একে আসছেন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।
কেউ স্মৃতি বলছেন, কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন।
কারো কথায় স্যারের কড়া শাসনের গল্প, কারো স্মৃতিতে তাঁর নিরব স্নেহ।
সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত স্মারক—‘আনিসুর রহমান’ নামটি কেবল একজন শিক্ষক নন, একটি প্রজন্মের মানচিত্র।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম।
সঞ্চালনায় ছিলেন প্রাক্তন শিক্ষার্থী নোমান ইবনে লতিফ ও সাইফুর রহমান সোহাগ।
বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন শিক্ষক মহসিন আলম, আসাদুজ্জামান রিপন, হারুন অর রশিদ, মোঃ সোরহাব হোসেন আকন্দ প্রমুখ।
প্রত্যেকেই যেন কণ্ঠ ভিজিয়ে বলছিলেন—
“স্যার, আপনি ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক, আপনি ছিলেন আমাদের জীবনের আলো।”
স্যার শুধু শিক্ষক নন, জীবনের দিকনির্দেশক
প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক মোঃ মইন উদ্দিন উজ্জ্বল, বর্তমানে নতুন সময় পত্রিকার ময়মনসিংহ ব্যুরো চিফ,
স্যারের কথা বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছিলেন বারবার, গলা কেঁপে উঠছিল আবেগে।
তিনি বলেন—আনিসুর রহমান স্যার শুধু পাঠদাতা নন, তিনি আমাদের জীবনের দিকনির্দেশক।
তাঁর কঠোরতার আড়ালে ছিল পিতার মতো মমতা।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—সততা ও শ্রদ্ধা কখনো পুরোনো হয় না।
এই কথাগুলো যেন সেদিনের আকাশকেও স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
প্রাঙ্গণের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল ভালোবাসার নিঃশব্দ সুর।
ফুলে ভরা ঘোড়ার গাড়িতে প্রিয় স্যারের প্রস্থান অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে দেখা গেল এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য—ফুলে মোড়ানো ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন প্রিয় শিক্ষক আনিসুর রহমান।
চারপাশে শিক্ষার্থীদের উল্লাস, রাস্তা জুড়ে ছিটানো ফুলের পাপড়ি,
আর বাতাসে ভেসে আসছে একটাই সুর—
স্যার, আপনি আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন
বিদ্যালয় থেকে বাড়ির পথে প্রতিটি মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
কেউ কাঁদছিল, কেউ হাসছিল, কেউবা নীরবে হাত নেড়ে জানাচ্ছিল শেষ শুভেচ্ছা।
সেই দৃশ্য যেন পুরো ময়মনসিংহের বুক ছুঁয়ে গেল।
এমন বিদায় কেবল সৌন্দর্যের নয়—এটি এক প্রজন্মের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।
বিদ্যালয়ই আমার প্রাণ, শিক্ষার্থীরাই আমার সম্পদ
নিজের বিদায়বেলায় অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে আনিসুর রহমান স্যার বলেন—
এই বিদ্যালয়ই আমার প্রাণ।
এই শিক্ষার্থীরাই আমার জীবনের সম্পদ।
তাঁদের ভালোবাসাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
আমি যা দিয়েছি, তার চেয়ে শতগুণ বেশি পেয়েছি ভালোবাসা।
কথাগুলো যেন প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে রইল।
করতালির শব্দে মিশে যাচ্ছিল কান্নার আওয়াজ—
একটি প্রজন্ম যেন তার আলোকবর্তিকাকে বিদায় জানাচ্ছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভরা হৃদয়ে।
বিদায় নয়, চিরন্তন অনুপ্রেরণার উত্তরাধিকার আনিসুর রহমান স্যারের বিদায় আসলে কোনো সমাপ্তি নয়—এটি এক আলোকিত জীবনের উত্তরাধিকার।
যে শিক্ষক সারাজীবন শিখিয়েছেন সততা, ভালোবাসা ও মানবিকতার পাঠ,
তাঁর আদর্শ চিরকাল পথ দেখাবে আগামী প্রজন্মকে।
যে মানুষ নীরবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মানুষ করে তুলেছেন,
তাঁর প্রতি এই শ্রদ্ধাঞ্জলি যেন এক অমর প্রার্থনা—স্যার, আপনি আছেন আমাদের প্রতিটি সাফল্যে,
আপনি আছেন আমাদের বিবেকের আলোয়,
আপনি আছেন আমাদের জীবনের প্রতিটি শিক্ষায়।
এটি কেবল একজন শিক্ষকের বিদায় নয়, এটি এক ভালোবাসার ইতিহাস—যেখানে জ্ঞানের আলো, মানবতার মমতা আর প্রজন্মের শ্রদ্ধা একসাথে গেঁথে গেছে এক হৃদয়স্পর্শী গল্পে।