
সোহেল রানা জয়ের রিপোর্ট চাটমোহর (পাবনা):
আবহমান বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের অংশ ঘোড় দৌড় এখনো টিকে আছে উৎসবের আমেজে। সেই ঐতিহ্যকে জিইয়ে রাখতে পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল বাঘলবাড়ি গ্রামে আয়োজন করা হয় দুই দিনব্যাপী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা। হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে জমজমাট এই উৎসবে অংশ নেয় দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৪০টি ঘোড়া।
দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখ মাসে ঘোড় দৌড় খেলা বেশি হলেও অঞ্চলভেদে অন্যান্য সময়েও এই খেলার আয়োজন হয়ে থাকে। তেমনি সোমবার ও মঙ্গলবার (২৭ ও ২৮ অক্টোবর) হান্ডিয়াল বাঘলবাড়ি গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠে অনুষ্ঠিত হলো দুই দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিযোগিতা।
বাৎসরিক গ্রামীণ উৎসবের অংশ হিসেবে বাঘলবাড়ি যুব সমাজের আয়োজনে এবং আলহাজ্ব আহম্মাদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা। এই আয়োজন ঘিরে সাজানো হয় দৌড়ের মাঠ ও অংশগ্রহণকারী ঘোড়াগুলো। মাঠে ঢল নামে আশপাশের এলাকার হাজারো নারী-পুরুষের।
ঘোড় দৌড় খেলায় আগত অতিথিরা বলেন, “আমাদের এই গ্রামীণ ঘোড় দৌড় শুধু একটি খেলা নয় এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। গামের মানুষ একসঙ্গে আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে, পরস্পরের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। আধুনিকতার যুগে এ ধরনের আয়োজন তরুণ প্রজন্মকে আমাদের সংস্কৃতি ও শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত করে তোলে। ভবিষ্যতেও যেন এ ঐতিহ্য ধরে রাখা যায়, সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”
আয়োজক কমিটির সদস্য মো. নুরুজ্জামান সরকার ও নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা কয়েক বছর ধরে এই ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছি। গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যেন হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে সেই লক্ষ্যেই আমাদের এই উদ্যোগ। আগামীতেও আরও বড় পরিসরে আয়োজন করার পরিকল্পনা রয়েছে।”
প্রতিযোগিতায় টাঙ্গাইল, বগুড়া, পাবনা, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রায় ৪০টি ঘোড়া অংশ নেয়। প্রথম দিনে ঘোড়াগুলোকে ছোট, মাঝারি ও বড় এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করে বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত দৌড় প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় তিন পর্বে কদম দৌড়, তিন পর্বে দাপট দৌড় এবং সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন পর্বে বিজয়ী তিন ঘোড়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় ফাইনাল রেস। পরে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় আকর্ষণীয় পুরস্কার।
প্রতিযোগিতা দেখতে চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, গুরুদাসপুর, তাড়াশ ও উাপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলার গন্যমান্য ব্যক্তি ও বিপুল সংখ্যক দর্শক উপস্থিত ছিলেন।
ঘোড় দৌড় দেখতে আসা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাবিবুর রহমান ও পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ছাইফুল ইসলাম বলেন, “ঘোড় দৌড় আমাদের গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। একসময় এ খেলা ছিল গ্রামবাংলার প্রাণের উৎসব, কিন্তু এখন তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এমন আয়োজন আমাদের ঐতিহ্যকে আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়।”
ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া তাড়াশ উপজেলার মোঃ হায়দার আলী বলেন, “আমি গত পাঁচ বছর ধরে ঘোড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি। এই খেলাটা শুধু প্রতিযোগিতা নয়, আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য আর গর্ব। ঘোড়া দৌড়ের জন্য সারা বছর ঘোড়ার যতœ নিতে হয়, নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হয়। হান্ডিয়াল বাঘলবাড়ির মাঠে এসে প্রতিযোগিতা করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এখানে দর্শকরা যেমন উৎসাহী, আয়োজনও ছিল দারুণ। এমন আয়োজন আরও বেশি হলে আমরা যারা এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছি, তারা অনুপ্রাণিত হবো।”
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনে উৎসবের আবহে জমে ওঠা এই ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা গ্রামীণ জনগণের মাঝে আনন্দ ও ঐতিহ্যের এক নতুন প্রাণসঞ্চার ঘটিয়েছে।