
মোঃ বাবুল ময়মসিংহ জেলা ব্যুরো প্রধান
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এই হাসপাতাল যেন মধ্যাঞ্চলের মানুষের শেষ আশ্রয়
দূর-দূরান্তের মানুষ, শহর-গ্রামের গরিব-অসহায় রোগীরা এখানে ভিড় করেন চিকিৎসার আশায়।
কেউ জামালপুর থেকে আসেন সিএনজিতে, কেউ শেরপুর থেকে ট্রেনে, কেউবা নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জ থেকে আশা বুকে নিয়ে আসেন হাসপাতালে।
কিন্তু—সেই আশা প্রায়ই ভেঙে যেত দালাল নামের এক নিষ্ঠুর চক্রের ফাঁদে। এই চক্রের সদস্যরা বছর বছর ধরে হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে, জরুরি বিভাগে, এমনকি ওয়ার্ডের ভেতরেও দাঁড়িয়ে থাকত লোভের জাল পেতে। তাদের চোখে রোগী নয়, ছিল লক্ষ্য তাদের মুখে মায়াবী হাসি, কিন্তু মনে ছিল নির্মম প্রতারণার হিসাব। হাসপাতালের দরজায় পা রাখতেই রোগী বা স্বজনের কানে বাজত মিথ্যা পরামর্শ। ভাই, এখানে ডাক্তার পাবেন না।বাইরে ভালো ডাক্তার আছে, একদম চিন্তা করবেন না। টেস্টগুলো এখানে করলে সময় লাগবে, বাইরে করলে রিপোর্ট ভালো আসবে। এইসব মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁদে পড়ে অসহায় রোগীরা যখন প্রাইভেট ক্লিনিকে যেতেন, তখন শুরু হতো টাকার লুটপাট। চিকিৎসার নামে প্রতারণা, কমিশনের নামে অমানবিকতা। কেউ জানত না, হাসপাতালের গেটের সেই সহায়ক মানুষগুলো আসলে এক সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের সদস্য।একজন ভুক্তভোগী বলেন আমার মাকে ভর্তি করাতে এসেছিলাম। গেটে দাঁড়ানো এক লোক বলল, এখানে জায়গা নেই, বাইরে ভালো ব্যবস্থা আছে । আমরা বিশ্বাস করে গেলাম, পরে বুঝলাম, এটা ছিল টাকা হাতানোর ফাঁদ।দীর্ঘদিন ধরে আসা এইসব অভিযোগ অবশেষে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) নজরে আসে।
র্যাব-১৪, ময়মনসিংহ ক্যাম্পের একটি বিশেষ দল গোপনে শুরু করে নজরদারি।সাদা পোশাকের সদস্যরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ হাসপাতাল এলাকায় অবস্থান নিয়ে পর্যবেক্ষণ চালান।অবশেষে, সব প্রমাণ হাতে নিয়ে র্যাব এক বিশেষ অভিযানে নামে।অভিযানে ধরা পড়ে দালাল চক্রের ১৮ সদস্য , যারা দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালকে নিজেদের আখড়া বানিয়ে রেখেছিল।অভিযান পরিচালনার সময় উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রাশিক খান শূষান যিনি ঘটনাস্থলেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে প্রত্যেককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড প্রদান করেন। র্যাব সদর কোম্পানি কমান্ডার স্কোয়াড্রন লীডার শাহ্ মোঃ রাশেত রাহাত জানায়, এই চক্রের কেউ হাসপাতালের ভেতরের দালাল, কেউ বাইরের ক্লিনিকের দালাল, কেউবা রোগী ধরে নেওয়ার মধ্যস্থতাকারী।চিকিৎসার মতো পবিত্র ক্ষেত্রকে যারা ব্যবসায় পরিণত করেছে, তাদের কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না।মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা র্যাব কখনো সহ্য করবে না। অভিযান অব্যাহত থাকবে।এই কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনিত হয় হাসপাতালের প্রাচীরজুড়ে , মানুষের চিকিৎসার অধিকারকে রক্ষার এক অঙ্গীকার হিসেবে।র্যাবের হাতে ধরা পড়া ১৮ দালালকে আদালতে হাজির করা হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রাশিক খান শূষান তাদের অপরাধের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা প্রদান করেন।
রায়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই হাসপাতাল এলাকায় সাধারণ মানুষের মুখে দেখা যায় স্বস্তির হাসি।এক রোগীর স্বজন বলেনএখন মনে হচ্ছে সত্যিই প্রশাসন আমাদের পাশে আছে। আগে ভাবতাম কেউ দেখবে না।ময়মনসিংহের নাগরিক সমাজ, চিকিৎসক, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষ সবাই র্যাবের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।তাদের দাবি—এই অভিযান যেন একদিনের নয়, বরং নিয়মিত হয়।
হাসপাতালের প্রতিটি কোণে নজরদারি বাড়ানো হোক, যেন আর কোনো নিরীহ মানুষ দালালদের হাতে প্রতারিত না হয়।নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রাশিক খান শূষান জানান ,হাসপাতালে যারা মানুষের দুঃখে ব্যবসা করছিল, তাদের দৌরাত্ম্য আজ থেমেছে।
হাসপাতালের পরিবেশ এখন থেকে নিয়মিত নজরদারিতে থাকবে।এরা কখনো রোগীর কান্নায় কাঁদে না,এরা শুধু হিসাব করে—একটি অসহায় প্রাণ মানে আরও একটি কমিশন।মানুষের জীবনের দুঃখকেও তারা বানিয়ে ফেলেছে টাকার খেলা।
এই চক্রের কারণে সাধারণ মানুষ সরকারি সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল,হাসপাতালের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। কিন্তু আজ, র্যাবের অভিযানে সেই মুখোশ খুলে গেছে।দেখা গেছে, মানবতার নামে লুকানো এক নির্মম ব্যবসার চেহারা।রোগীর সেবা যেখানে পবিত্র দায়িত্ব, সেখানে প্রতারণা এক গভীর অপরাধ।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে র্যাবের এই অভিযান শুধু ১৮ জন দালালের গ্রেফতার নয় —
এটি মানবতার প্রতি এক জাগরণ, এক প্রতিবাদ, এক পুনর্জাগরণ।মানুষ এখন আশাবাদী, এই পদক্ষেপই শুরু হোক এক দালালমুক্ত হাসপাতাল আন্দোলনের,
যেখানে থাকবে না প্রতারণা, থাকবে শুধু চিকিৎসা, সেবা আর মানবতার আলো।মানবতার কাছে অপরাধীর কোনো আশ্রয় নেই,সেবার মন্দিরে দালালের কোনো স্থান নেই।