
এসএম বদরুল আলমঃ গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল (ই/এম) শাখার উপসহকারী (ডিপ্লোমা) প্রকৌশলী মো. ফারুক হোসেন মাত্র ছয় বছরেই হয়ে উঠেছেন কোটিপতি। ২০১৯ সালে স্বৈরাচার সরকারের আমলে চাকরিতে যোগ দেওয়া এই কর্মকর্তা দ্রুতই মন্ত্রী পাড়ায় পোস্টিং পান। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফের তদবিরে ২০২১ সালের শেষদিকে তিনি সেখানে যোগ দেন। এরপর থেকেই নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড, ঠিকাদারি কারসাজি ও দাপ্তরিক দুর্নীতিতে হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী।
ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মন্ত্রী পাড়ার বিভিন্ন ভবন, সরকারি বাসভবন ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কোয়ার্টারে একই কাজ বারবার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখান। এসব কাজে বেনামী ঠিকাদারদের মাধ্যমে অনিয়ম করে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে ঢাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নিজ জেলা ঝিনাইদহে দোতলা বাড়ি ও প্রায় ১০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন তিনি—এমনটাই জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র।
গত ৮ অক্টোবর ২০২৫ সালে তাকে গণপূর্তের ই/এম ৭নং ডিভিশনের ১৪নং সাবডিভিশনের সেকশন কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়। তবে অভিযোগ আছে, ওই বদলি ও অতিরিক্ত এক মাস এক্সটেনশন পেতে তিনি প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। এমনকি বদলির সময় একজন আনডিউ প্রকৌশলীকে সরিয়ে নিজের প্রভাব খাটিয়ে সেই পদে বসেছেন।
২০২১ থেকে ২০২৫ অর্থবছর পর্যন্ত বেইলি রোড, মিনিস্টার্স এপার্টমেন্ট, রমনা পার্ক, ফরেন সার্ভিস একাডেমি, রাষ্টীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা, প্রধান বিচারপতির বাসভবন, ডিএমপি সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন স্থাপনার ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল কাজের নামে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে হেয়ার রোডের সরকারি বাংলোগুলোর সংস্কার ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বৈদ্যুতিক সংস্কার কাজের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ২ কোটি টাকা (১,৯৯,৫১,৫২৮)। অথচ বাস্তবে কাজ হয়েছে অর্ধকোটি টাকার মতো। বাকি টাকায় চলে ভাগ-বাটোয়ারা।
এছাড়া একই অর্থবছরে—
হেয়ার রোডের ৬নং বাংলোয় ২১ লাখ ৮৪ হাজার টাকায় গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি সরবরাহ দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ,
এটর্নি জেনারেলের বাংলোয় ২৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকায় লাইট, ফ্যান, এসি ও অন্যান্য সরঞ্জাম স্থাপনের নামে অনিয়ম,
২নং বাংলোয় ১১ লাখ টাকায় সিকিউরিটি লাইট ও পাম্প সরবরাহের নামে জালিয়াতি,
৪নং বাংলোয় ২৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকায় বৈদ্যুতিক ফিটিংস নবায়নের নামে কারসাজি,
২নং বাংলোয় ৩৩ লাখ টাকায়,
এম-৩ উত্তরায়ন বাংলোয় ৩০ লাখ টাকায়,
৩৫নং বাংলোয় ২৩ লাখ টাকায়,
এম-১৫ নিকেতনে ৪০ লাখ টাকায়,
আর ৬নং বাংলো নিলয়ের পুলিশ ব্যারাকে ২৩ লাখ টাকায় অনিয়মের ছড়াছড়ি।
সব মিলিয়ে, কাগজে-কলমে যে পরিমাণ কাজ দেখানো হয়েছে তার অর্ধেকেরও কম বাস্তবে সম্পন্ন হয়েছে। পুরনো ভালো যন্ত্রপাতিকে “অকার্যকর” দেখিয়ে নতুন সরবরাহের নামেও হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ।
একাধিক ঠিকাদার জানিয়েছেন জানিয়েছেন—এসব পুরনো যন্ত্রপাতি বিক্রি করেও ফারুক অর্ধকোটি টাকা পকেটে তোলেন। এ ছাড়াও এসি, ফ্রিজ, ওয়াটার পাম্প, ওয়াটার হিটার, জি-সায়ার, এমনকি সিসিটিভি ক্যামেরা, ইন্টারকম—এসব সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধু হেয়ার রোড এলাকার বিভিন্ন বাংলোতে করা কাজের চুক্তিমূল্যই ছিল কয়েক কোটি টাকা। অথচ বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই অর্ধেক কাজও সম্পন্ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে—এই বরাদ্দের বড় অংশ ভাগবাটোয়ারা হয়েছে বিভিন্ন স্তরে, যার মূল সমন্বয়কারী ছিলেন উপসহকারী প্রকৌশলী ফারুক।
এ সব অভিযোগে যোগাযোগ করা হলে উপসহকারী প্রকৌশলী ফারুকের মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি।