আওরঙ্গজেব কামালঃ
আবারও সেই আগুন সন্ত্রাসের সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি! ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে,দেশে নিরেপক্ষ সরকার রয়েছে কিন্তু আগুন সন্ত্রাস নির্মূল হয়নি। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে ব্যাপক আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। ওই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তাঁরা বিএনপি-জামায়াতকে এসব ঘটনার জন্য দায়ী করতেন। সেই আওয়ামী লীগেরই ডাকা কর্মসূচি ঘিরে গত কয়েক দিন ধরে যানবাহনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেখে হতাশ হচ্ছেন সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞরা। পুলিশের সন্দেহের তীর কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের দিকে। এরই মধ্যে সন্দেহভাজন অনেককে পেট্রলবোমাসহ গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ ও র্যাব। তাহলে কি আমরা ভেবে নেব আগে যে ঘটনা ঘটেছিল সবই আওয়াশীলীগের দ্বারা সংঘটিত আর সেই দায় জামাত -বিএনপির উপর দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে যানাযায়,সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বড় শহরে আবারও ফিরে এসেছে অগ্নিসন্ত্রাসের ভয়াবহ চিত্র। রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনমনে শঙ্কা যেন এখন চরমে।
এর জন্য গণভোট নাকি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফাঁসীর রায় দায়ী এমন প্রশ্ন সর্বসাধারনের । আসন্ন নির্বাচন ও নেতৃত্বের সংকট সবমিলিয়ে দেশের মধ্যে চলছে চরম অশুভ সংকেট। মানুষের জানমালের হানী এর দায় ভার কে নিবে। দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে গণপরিবহনে আগুন,ককটেল বিস্ফোরণ এবং ভাঙচুরের ঘটনা জনমনে তীব্র আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।
এ ছাড়া ঘরের মধ্যে মানুষ নিরাপদ নয়। প্রতিনিয়ত অকারনে মানুষ কে প্রাণ দিতে হচ্ছে। খানা খন্দকে লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এক কথায় দেশের এই পরিস্থিতি শুধু আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতির ইঙ্গিতই দেয় না, বরং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকেও এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায়ের আগে ঢাকায় ৫ যানবাহনে অগ্নিসংযোগ হয়েছিল, ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে দেশের অনেক যায়গায়। ময়মনসিংহে নাশকতার আগুনে পুড়ে কয়লা গাড়িচালক এর দায় কে নেবে। রায়ের আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) তদন্ত সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চত্বরে নিক্ষেপ করা হয়েছে ককটেল। ময়মনসিংহে বাসে আগুনে মৃত্যু হয়েছে ঘুমন্ত চালকের। আহত হন আরও দুজন। আগের দিনও ককটেল নিক্ষেপ করা হয় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে, তিনটি বাসে করা হয় অগ্নিসংযোগ। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী প্রায় শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।
মানুষ এখন গণপরিবহণে উঠতে ভয় পাচ্ছেন। দেশে দেশে সরকার বদলায়, মতের লড়াই হয়, কিন্তু সাধারণ নাগরিকের জীবন নিয়ে এমন খেলা শেষ হয় না। যাঁরা একসময় বলতেন আগুন সন্ত্রাস যারা করে তারা জনগণের শত্রু। তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এমন ঘটনাই লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, দিন দিন বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে—এমন সময় এই সহিংসতার নেপথ্যে কারা এবং কার স্বার্থে এতো অস্থিরতা—এই প্রশ্ন আজ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। দেশজুড়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আগুন-সন্ত্রাস যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তা যেন পুরো রাষ্ট্রকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত মামলার ফাঁসির রায় ঘোষণার আগে থেকেই অস্থিরতার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
রায় ঘোষণার পর সেই অস্থিরতা যেন বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক উত্তেজনা, উস্কানি এবং প্রতিশোধ পরায়ণ শক্তির প্রকাশ্য মুখোশ খুলে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশ এক অন্ধকার সময়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। রায়ের আগের ৪৮ ঘণ্টা থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং বাজারে অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো ক্রমে তীব্র হতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি নজরদারির পরও সহিংসতা দমন করা যায়নি। ইতোমধ্যে বেশ কিছু গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে সংঘবদ্ধ হামলা শুরু হয়। গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ, ট্রেনের রেললাইন উপড়ে ফেলা, বিদ্যুৎকেন্দ্রে নাশকতার প্রচেষ্টা—সব মিলিয়ে দেশ এক অরাজক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হয়েছে। মানুষের মধ্যে এখন প্রবল ভীতি; রাতে শহরের আকাশে লাল আগুনের আলো ঝলসে ওঠে আরেকটি নতুন অগ্নিকাণ্ডের। উদ্ধারকারী দল, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা ছুটে বেড়ালেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত দেশজুড়ে আগুন-সন্ত্রাস, সংঘর্ষ এবং নাশকতায় মোট ৪ জন নিহত হিসাব প্রকাশিত হলেও হয়তোর এর সংখ্য আরো বাড়তে পারে এবং কয়েকশ মানুষ আহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিহতদের বেশিরভাগই নিরপরাধ সাধারণ মানুষ—রিকশাচালক, দোকানদার, যাত্রী কিংবা শ্রমিক। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার চরম রূপ এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা—এই দুই মিলিয়ে রাষ্ট্রের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা বজায় রাখা। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, দ্রুত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে দেশের অর্থনীতি, সরবরাহ ব্যবস্থা এবং সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতি অতীতে বহু সহিংস সময় দেখেছে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জটিল ও অস্থিরতার একটি অধ্যায়। নেতৃত্বের বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক সংলাপের উদ্যোগ এবং নাগরিক নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়াই এখন রাষ্ট্র রক্ষার একমাত্র পথ। কারণ, আগুনের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত ছাই করে দেয় সব—পক্ষ, বিপক্ষ ও নিরীহ মানুষ, সবাইকে।
জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য একদিকে দুর্ভাগ্য ও কলঙ্কের, কারণ সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই রাষ্ট্রের মাটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আবার অন্যদিকে এক সত্যিকারের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই অপরাধকারীদের পতন ঘটিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা—এটিও আমাদের গৌরবের অংশ। অপরাধকারীদের পতনের পর রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত হয়েছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার গুরুদায়িত্ব। প্রতিটি ন্যায়বিচার ভবিষ্যতে একই ধরনের অপরাধের প্রতি নিবৃত্তকারী হিসেবে কাজ করে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল,তা কেবল হত্যা বা নির্যাতনের ঘটনা নয়—এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতাভুক্ত। শুধু জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান নয়, তার পুরো শাসনামলজুড়েই গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী রাজনৈতিক দল—বিশেষ করে বিএনপি এবং এক সময় জামায়াতের কর্মীদের ওপর নানা রকম নিপীড়ন, হেফাজতে নির্যাতন এবং গায়েবি মামলার মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটেছে। এগুলোও মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে।
এটি স্পষ্ট যে, অপরাধমূলক অগ্নিসংযোগ আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়—এটি রাজনৈতিক অস্থিরতার গভীরতর উপস্রোত। এই সন্ত্রাস যদি অব্যাহত থাকে, তবে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়বে। তাই সরকার ও সব রাজনৈতিক পক্ষের এখনই দায়িত্ব নিতে হবে—সহিংসতার উৎস চিহ্নিত করা, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সাংবিধানিক রাজনৈতিক পরিবেশ পুনরুদ্ধার করার জন্য সংলাপের পথ উন্মুক্ত করা। কারণ শেষ সত্যটি হলো—সহিংসতা কখনোই কোনো জাতির মুক্তির পথ নয়; বরং তা ধ্বংস করে দেয় ভবিষ্যৎ, অগ্রগতি এবং মানবিকতার ভিত্তি। আগুন-অগ্নিসংযোগ বা বিস্ফোরণ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সংবাদ মাধ্যম বলেছে “গত এক সপ্তাহে ৫০-এর বেশি ককটেল ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা” এবং কমপক্ষে ৩ জন মারা গেছেন। কমপক্ষে তিন-ডজনের কাছাকাছি বিস্ফোরণ হয়েছে শুধু রাজধানীতে । ফলে এখন আইন শৃঙ্খলাবাহীনীকে কঠিন ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশের সর্বস্তরের জনসাধারনের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো— সহিংসতার প্রকৃত নেপথ্য চক্র শনাক্ত করা। কি কারনে এবং কারা করছে সেটা খুঁজে বাহির করতে হবে।
দৃঢ় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে জোরদারের উদ্যেগ নেওয়া এবং রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সাংবিধানিক পরিবেশ পুনঃস্থাপন কারণ, সহিংসতা শেষ পর্যন্ত সকল পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে—পক্ষ–বিপক্ষ ভেদে নয় সেটার যথাযথ বিচার করা। অবশ্যই আমরা সকলে জানি হুমকির মুখে পড়ে একটি জাতির সামগ্রিক অগ্রগতি অনেকটাই বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে সকল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অতি জরুরি—চাই তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ হোক, কিংবা সাম্প্রতিক সহিংসতার পরিকল্পনাকারীদের বিচারের বিষয় হোক। প্রতিটি সঠিক বিচার ভবিষ্যতের জন্য নিবৃত্তকারী শক্তি হিসেবে কাজ করে।
লেখক ও গবেষকঃ
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি
ঢাকা প্রেস ক্লাব ও
আওরঙ্গজেব কামাল
১। অগ্নিসন্ত্রাসে অবরুদ্ধ রাষ্ট্র: নিরাপত্তাহীনতার এই দুঃসময় থেকে
উত্তরণের পথ কী?
২। নাজেহাল দেশ, বিপন্ন জননিরাপত্তা: আগুন–সন্ত্রাস মোকাবিলার কি কার্যকর পথ আছে?
৩। অবিরাম আগুন–বিস্ফোরণে চরম অস্থিরতা: শান্তি ফিরবে কীভাবে?
৪। অরাজকতার আগুনে পুড়ছে সমাজ—সমাধান কি কেবল শক্ত হাতে, নাকি সংলাপে?
৫। জাতীয় নিরাপত্তায় অগ্নিঝুঁকি: রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিকার কোন পথে?