
জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল মুহূর্ত হয়ে থাকবে। এটি ছিল এমন এক গণজাগরণ, যেখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নয়- বরং ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটিয়েছিল। সেই অভ্যুত্থান কেবল একটি সরকারের পতন নয়; এটি ছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে নতুনভাবে কল্পনা করার এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
কিন্তু আজ, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড সেই আশাবাদী যাত্রাকে গভীর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
হাদির মৃত্যু কেবল একজন রাজনৈতিক কর্মী বা সম্ভাব্য সংসদ সদস্যের প্রাণহানি নয়। এটি জুলাই অভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত বিকল্প রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারার ওপর এক নির্মম আঘাত। গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যুর সংবাদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলেও সহিংস রাজনীতির পুরোনো কাঠামো এখনো ভাঙা হয়নি।
হাদির রাজনৈতিক অবস্থান ছিল ব্যতিক্রমী। অভ্যুত্থানের পর যখন তরুণদের বড় একটি অংশ দ্রুত দল গঠন, ক্ষমতার সমীকরণ কিংবা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রবেশে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, হাদি তখন ভিন্ন পথ বেছে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ফ্যাসিবাদ কেবল রাষ্ট্রক্ষমতার ভেতর সীমাবদ্ধ নয়; এটি সংস্কৃতি, বয়ান, ইতিহাসচর্চা ও সামাজিক মানসিকতার ভেতর গভীরভাবে প্রোথিত থাকে। তাই ইনকিলাব মঞ্চের মতো একটি উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলে তিনি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের কথা বলেছিলেন।
এই অবস্থানই তাঁকে বিপজ্জনক করে তুলেছিল- পুরোনো শাসনব্যবস্থার অবশিষ্ট শক্তি এবং সহিংস নেটওয়ার্কগুলোর কাছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন রাজধানীর ব্যস্ত এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে হাদির মাথায় গুলি করার ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়। এটি ছিল পরিকল্পিত রাজনৈতিক সহিংসতা- যার লক্ষ্য ব্যক্তি হত্যার পাশাপাশি নির্বাচনী পরিবেশকে ভীতিকর করে তোলা। অতীতে যেমন দেখা গেছে, ভীতি সৃষ্টি করে প্রার্থী ও ভোটারদের নিরুৎসাহিত করাই ছিল সন্ত্রাসী রাজনীতির প্রধান কৌশল।
হাদির হত্যাকাণ্ড সেই পুরোনো ছকেরই পুনরাবৃত্তি।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই ঘটনায় রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা আবারও প্রকাশ পেয়েছে। হত্যার হুমকি আগেই জানানো হয়েছিল, হামলার পর প্রধান সন্দেহভাজনের দেশত্যাগের আলোচনা রয়েছে, এবং তদন্তে বেসরকারি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভূমিকা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান- এই বাস্তবতা প্রশ্ন তোলে, অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা সংস্কার হয়েছে।
আরও গভীর সংকটটি রাজনৈতিক ঐক্যের জায়গায়। জুলাই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল ন্যূনতম গণতান্ত্রিক লক্ষ্যে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্য। কিন্তু হাদির হত্যাকাণ্ডের পর সেই ঐক্যের প্রতিফলন স্পষ্ট নয়। দলমত নির্বিশেষে সর্বদলীয় প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক সংহতি যেখানে জরুরি ছিল, সেখানে আমরা দেখছি দ্বিধা, হিসাব-নিকাশ এবং নীরবতা।
ইতিহাস আমাদের শেখায়- গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সময় বিভাজনই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। বিভক্ত শক্তির সুযোগ নিয়েই পরাজিত স্বৈরাচার নতুন রূপে ফিরে আসে। বাংলাদেশও আজ সেই ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে।
হাদি ছিলেন গ্রামবাংলা থেকে উঠে আসা এক সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি- মাদ্রাসা শিক্ষকের সন্তান, কবি, শিক্ষক ও সংগঠক। তাঁর রাজনীতি ছিল এলিট নয়, জনভিত্তিক। ফজরের নামাজের পর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাওয়া, ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ, সাধারণ মানুষের অনুদানে প্রচারণা- এসব ছিল রাজনীতিকে মানবিক ও স্বচ্ছ করার এক প্রয়াস। তাঁর হত্যাকাণ্ড তাই মানুষের মনে গভীর আবেগ ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে একটি মৌলিক প্রশ্ন রেখে যায়: জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ কি সত্যিই গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে, নাকি পুরোনো সহিংস শক্তি নতুন কৌশলে আবারও প্রভাব বিস্তার করছে?
এর উত্তর নির্ভর করবে কয়েকটি বিষয়ের ওপর- রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত সংস্কার, সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ধ্বংস, অবাধ ও নিরাপদ নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐক্য গড়ে তোলা।
শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড যদি কেবল একটি অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হয়, তবে সেটি হবে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এটিকে দেখতে হবে একটি সতর্ক সংকেত হিসেবে- যে সংকেত জানিয়ে দেয়, গণতন্ত্র এখনো অসম্পূর্ণ, লড়াই এখনো শেষ হয়নি।
হাদির রক্ত যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- ঐক্য, সহনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের অর্জন টেকসই হবে না। অন্যথায়, এই অভ্যুত্থানও ইতিহাসের আরেকটি অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
ডঃ এ জেড এম মাইনুল ইসলাম পলাশ
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক