
প্রতিবেদক: জাহেদ আলম স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার | ২৭ অক্টোবর ২০২৫
বাংলার সীমান্তে দুই শতাব্দীর গৌরবগাথা—৪,৪২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেখার প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষিত হচ্ছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়। স্বাধীনতার সূর্যোদয় থেকে আজ পর্যন্ত দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) অটল নিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন করে চলেছে।
১৯৪৮ সালের ২৭ অক্টোবর ময়মনসিংহের খাগডহরে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাটালিয়ন—আজ টেকনাফে দাঁড়িয়ে ৭৭ বছরের ইতিহাসে রচনা করেছে বীরত্বের অসংখ্য অধ্যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে বর্তমান মাদকবিরোধী অভিযান—সবখানেই এই বাহিনী রেখেছে অমলিন অবদান।
এই দীর্ঘ অভিযাত্রায় ৩৪ জন বীর সেনানীর আত্মত্যাগে লেখা আমাদের মুক্তির ইতিহাস। ১৯৭৯-৮০ সালে সন্ত্রাস দমনে পাঁচজন সদস্য শহীদ হন। বহু সাহসী যোদ্ধা পেয়েছেন ‘বীর প্রতীক’। ১৯৯৯ সালে ব্যাটালিয়নটি অর্জন করে ‘বাংলাদেশ রাইফেলস স্ট্যান্ডার্ড পদক’।
অপারেশন দাবানল, পাঞ্চিং টাইগার, পূর্ব প্রাচীর—এই তিনটি ঐতিহাসিক অভিযানে বিজয়ের পতাকা ওড়ায় এই ব্যাটালিয়ন। ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর টেকনাফে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিটি দিন ও রাত তারা রক্ষা করছে দেশের দক্ষিণ সীমান্ত।
সততা, আনুগত্য, নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা—এই চার স্তম্ভে দাঁড়িয়ে ২ বিজিবি এখন জাতীয় নিরাপত্তা, সীমান্ত সুরক্ষা ও মাদকবিরোধী অভিযানে “জাতির গর্ব ও আস্থার প্রতীক”। বিজিবির ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র ইউনিট হিসেবে ব্যাটালিয়নটি ৩০ কিলোমিটার উপকূল ও ২৩ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা জুড়ে অত্যাধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করেছে।
২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮—টানা তিন বছর “বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি” অর্জন করেছে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে তারা গ্রেফতার করেছে ১৭৯ জন আসামি, উদ্ধার করেছে ২.০৮৮০৩ কেজি স্বর্ণ, ৪.২০৬ কেজি ক্রিস্টাল মেথ (আইস) এবং ৫৭ লক্ষাধিক ইয়াবা ট্যাবলেট।
এছাড়াও জব্দ করেছে দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গ্রেনেড, রকেট লঞ্চারের গোলা, ও বিপুল পরিমাণ গুলি। এক বছরে ২১৮ কোটি ২৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকার মাদক ও চোরাচালান সামগ্রী জব্দ করেছে ব্যাটালিয়নটি।
মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বিজিবি’র টেকনাফ ব্যাটালিয়ন নিরাপদে প্রত্যাবাসন ও নিরস্ত্রীকরণ করেছে ৩৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যকে। উদ্ধার করেছে ৩৮৭ জন অপহৃত ব্যক্তিকে এবং আটক করেছে ৮৭ জন মানবপাচারকারীকে।
আরাকান আর্মির হাতে আটক ১২৪ জন বাংলাদেশি জেলে, ১৮টি নৌকা ও বিপুল পরিমাণ জাল ফেরত আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই ব্যাটালিয়ন।
মানবিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে ৪৪০ জনের মধ্যে, ৮টি মেডিকেল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে ১,০৯৭ জনকে এবং প্রায় ১,০০০ অসহায় মানুষকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান, পিএসসি বলেন,
“যতদিন উড়বে লাল-সবুজ পতাকা, ততদিন আমরা দেশের সর্বদক্ষিণ সীমান্তের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। এই দিনে যাদের আত্মত্যাগ ও শ্রমে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন আজকের মর্যাদায় এসেছে—তাঁদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ—সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা ও দেশপ্রেমে নিজেদের অর্পিত দায়িত্ব পালনে কখনো পিছপা হবো না। প্রয়োজনে মাতৃভূমির অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করবো না।”
৭৭ বছরের বীরত্ব, দায়িত্ব ও আত্মত্যাগে গড়া এই বাহিনী আজও সীমান্তের প্রতিটি ইঞ্চিতে জাতির নিরাপত্তার প্রতীক। “২ বিজিবি”—একটি নাম, একটি গর্ব, এক অটল প্রতিজ্ঞা দেশের সীমান্তে আস্থা ও সাহসের অন্য নাম।