
জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ ২০২৫-এর কেন্দ্রীয় প্রদর্শনী ঢাকার আগারগাঁওয়ের পুরোনো বাণিজ্যমেলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি: প্রাণিসম্পদে হবে উন্নতি’- এই প্রতিপাদ্য কেবল একটি স্লোগান নয়; এটি দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং নীতি-নির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনার প্রতিফলন। প্রতি বছর এই প্রদর্শনী প্রাণিসম্পদ শিল্পের বর্তমান অবস্থা, উদ্ভাবন ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তুলে ধরে।
২০২৫ সালের প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু দেশের প্রাণিসম্পদ খাতকে আধুনিকায়নের পাশাপাশি লাভজনক ও টেকসই করার উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে।
▪ দেশি বনাম সংকর জাত: উৎপাদন বনাম জিন সংরক্ষণ
প্রদর্শনীতে দর্শকদের নজর কেড়েছে হরিয়ানা ক্রস এবং গ্রাহামা ক্রস জাতের গরু। ঢাকাইয়া ক্যাটল ফার্মের স্টলে ২৫ লাখ টাকার হরিয়ানা ক্রস গরুর ভিড় থেকে বোঝা যায়, সংকর জাতের প্রতি ব্যবসায়ী এবং খামারিদের আগ্রহ কতটা প্রবল। সংকর জাতের প্রধান সুবিধা হলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি- দুধ, মাংস এবং বাচ্চা উৎপাদনে সংকর জাত দ্রুত ফলপ্রসূ। এটি খামারিদের আয় বাড়ায় এবং দেশীয় বাজারে যোগান নিশ্চিত করে।
তবে দীর্ঘমেয়াদে সংকর জাতের অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের জিনগত বৈচিত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। লাল, হলদে, ককটেল বা অন্যান্য দেশি জাতের সংরক্ষণ না করলে প্রাকৃতিক অভিযোজন এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নীতি-নির্ধারকদের বড় চ্যালেঞ্জ হলো- কিভাবে সংকর জাতের উৎপাদন বাড়ানো যায় এবং একই সঙ্গে দেশি জাত সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যায়।
▪ পানি ছাড়া হাঁস: জলবায়ু-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন
প্রদর্শনীর অন্যতম আলোচিত উদ্ভাবন ছিল প্ল্যানেট অ্যাগ্রো আনা ফরাসি হাঁস। সাধারণত হাঁস পালন প্রচুর পানি প্রয়োজন। কিন্তু জলাশয় এবং পানি সঙ্কুল এলাকার অভাবে বাংলাদেশে হাঁস খাতের সম্প্রসারণ ঝুঁকিপূর্ণ। এই ফরাসি হাঁস মাত্র ৪৫ দিনে ৩ কেজি পর্যন্ত ওজন অর্জন করতে সক্ষম এবং মাচা বা শুকনো স্থানে পালনযোগ্য।
এর অর্থ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোল্ট্রি খাতকে আরও স্থিতিশীল করা সম্ভব। তবে বড় আকারে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের আগে স্থানীয় পরিবেশে অভিযোজন, রোগপ্রবণতা, খরচ এবং ব্যবস্থাপনার দিকগুলো যাচাই করা আবশ্যক।
▪ ফিড ইন্ডাস্ট্রি: আমদানিনির্ভরতা থেকে স্বনির্ভরতার দিকে
বাংলাদেশে বহু বছর ধরে চিংড়ি ও অন্যান্য প্রাণিসম্পদ খাদ্য মূলত আমদানি নির্ভর ছিল, বিশেষ করে বাগদা চিংড়ির খাবার। তবে আস্থা ফিডের উদ্যোগে দেশীয়ভাবে উচ্চমানের বাগদা চিংড়ির খাবার উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রতি কেজির দাম ৭০-৯০ টাকা, যা আমদানিকৃত খাদ্যের চেয়ে ৮-১০ টাকা কম। প্রতিষ্ঠানটির আশা, আগামী দুই বছরের মধ্যে চিংড়ি খাদ্য আমদানি প্রয়োজন হবে না।
এছাড়া, নারিশ অ্যাগ্রো মাসে এক লাখ টন ফিড বিক্রির মাইলফলক অর্জন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত, নিরাপদ ফিড সরবরাহের মাধ্যমে বাজারে স্বনির্ভরতা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করছে। স্থানীয় ফিড উৎপাদন, খামারিদের খরচ কমানো এবং নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ- এগুলো টেকসই প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরিবেশগত প্রভাব, মান নিয়ন্ত্রণ এবং রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সব সময় নজরদারিতে রাখতে হবে।
▪বড় খামার বনাম প্রান্তিক খামার: বাজারে বৈষম্য
দেশে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক খামার ৮৫,২২৭টি, আর প্রান্তিক পর্যায়ে প্রায় ১,৯১,০০০ পোল্ট্রি খামার রয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠান যেমন প্যারাগন ফিড, হ্যাচারি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, এবং খুচরা দোকান সব এক প্ল্যাটফর্মে পরিচালনা করছে। এ ধরনের vertically integrated খামার বড় খামারিদের বাজারে প্রভাব শক্তিশালী করে, কিন্তু ছোট প্রান্তিক খামারি সমান সুযোগ পাচ্ছে না।
মূল চ্যালেঞ্জ হলো: কিভাবে ছোট খামারিদের বাজারে সমান সুযোগ এবং লাভের সুযোগ দেওয়া যায়। সমবায়ভিত্তিক বিপণন, খামারি-ভোক্তা সরাসরি সংযোগ এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ টেকসই সমাধান হতে পারে। প্রান্তিক খামারির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না হলে খাতের সামাজিক প্রভাব সীমিত হবে।
▪ নিরাপদ খাদ্য, প্রাণিকল্যাণ ও সামাজিক শিক্ষা
প্রাণিসম্পদ সপ্তাহে প্রাণিকল্যাণ, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং শিশু ও পরিবারের শিক্ষামূলক কার্যক্রমও তুলে ধরা হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার প্রাণিকল্যাণের আইনি প্রয়োগ, কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ এবং তামাক চাষের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র নীতি গ্রহণের গুরুত্ব দিয়েছেন।
লাইভ ট্রান্সপোর্ট, কসাইখানা, ফার্ম-ম্যানেজমেন্ট- এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ না করলে রপ্তানি সম্ভাবনা সীমিত থাকে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা এবং সমাজে প্রাণিকল্যাণের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
▪ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের একত্রিত দিকনির্দেশনা
জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ ২০২৫ প্রদর্শনীতে দেখা গেছে, কিভাবে দেশি ও সংকর জাতের প্রাণী, আধুনিক ফিড, অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত খাদ্য, পানি-সঙ্কুল এলাকার হাঁস প্রজাতি- সব একত্রে খাতের উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়।
বাণিজ্যিক উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্থানীয় খামারি ও বড় শিল্পগোষ্ঠী উভয়ই লাভবান হচ্ছে। তবে মূল চ্যালেঞ্জ হলো: এই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে সর্বজনীনভাবে এবং টেকসইভাবে খাতের সকল স্তরে পৌঁছে দেওয়া।
▪ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে অবদান
প্রাণিসম্পদ খাত বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং রপ্তানি সম্ভাবনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেশীয় জাত সংরক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রান্তিক খামারির বাজারে অংশগ্রহণ এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন- এসবের সমন্বয়ে খাতটি টেকসই উন্নয়নের পথে এগোতে পারে।
জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ ২০২৫ প্রদর্শনী প্রমাণ করেছে, কেবল উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। গবেষণায় বিনিয়োগ, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, বাজার সংস্কার, প্রান্তিক খামারির ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক সচেতনতা- এসব মিলিতভাবে খাতের বাস্তব উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
▪ চূড়ান্ত বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাত এখন একদিকে উদ্ভাবন ও আধুনিকায়নের ধাপে, অন্যদিকে জিন সংরক্ষণ, সামাজিক দায়িত্ব এবং পরিবেশগত মানের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দেশি এবং সংকর জাতের সমন্বয়, নিরাপদ খাদ্য, ফিড উৎপাদন, বাজার বৈষম্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনের যৌথ প্রয়োগ ছাড়া খাতের টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব।
জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ ২০২৫ শুধুই একটি প্রদর্শনী নয়; এটি দেশের প্রাণিসম্পদ খাতকে নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম। দেশীয় জাতের সংরক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রান্তিক খামারির বাজারে অংশগ্রহণ, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং সামাজিক সচেতনতা- এসব মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে পারলেই বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাত বাস্তব অর্থে টেকসই ও লাভজনক হবে।
লায়ন ড. এ জেড এম মাইনুল ইসলাম পলাশ
লেখক সাংবাদিক কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী