
বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো নারী আসামির ফাঁসি কার্যকর না হওয়ার যে ইতিহাস, তা আবারও জাতীয় বিতর্কের কেন্দ্রে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার পর প্রশ্ন উঠেছে- রাষ্ট্র কি তার দীর্ঘদিনের অনুশীলিত ‘লিখিত নয় এমন’ নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, নাকি নতুন কোনো নজির তৈরি করবে?
এই প্রশ্ন শুধুই আইনি নয়; এতে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রচরিত্র, রাজনৈতিক স্থিতি, মানবাধিকার চর্চা এবং সামাজিক মনস্তত্ত্ব।
▪️ নারীর মৃত্যুদণ্ড: আইনের অক্ষরে নেই পার্থক্য, কিন্তু বাস্তবে আছে ব্যতিক্রম
বাংলাদেশের আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান লিঙ্গভেদ মানে না। কিন্তু বিচার-পরবর্তী বাস্তবতায় নারীর ক্ষেত্রে ফাঁসি কার্যকর না করার ধারাবাহিকতা যেন এক অলিখিত নীতি। স্বাধীনতার পর থেকে শতাধিক নারী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেও কারোর ফাঁসি কার্যকর হয়নি। দেশের একমাত্র নারী কারাগারেও নেই ফাঁসির মঞ্চ- যা কেবল কারাগার পরিকাঠামোর অভাবই নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রয়োগকৃত নীতির গভীর ইঙ্গিত।
এ পরিস্থিতি প্রশ্ন তোলে- আইনের সমতার ধারণা কি বাস্তব প্রয়োগে লিঙ্গভেদে ভিন্ন হয়ে পড়ছে?
▪️ সাবেক প্রধানমন্ত্রী- এক ভিন্ন মাত্রার সংবেদনশীলতা
বিশ্বের যেকোনো দেশে সাবেক রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের বিচারে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত জটিল হয়। রায় যতই আইনি প্রক্রিয়া অনুসারে হোক, তার বাস্তবায়ন সবসময়ই রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতির সমীকরণে বাঁধা থাকে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এই সংবেদনশীলতা আরও বহুগুণ-
* দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
* আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
* আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের নজরদারি
* মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ
এসব মিলিয়ে দণ্ড কার্যকর করা বা স্থগিত রাখা- উভয় সিদ্ধান্তই বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
▪️ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা কি ভবিষ্যতেও বহাল থাকবে?
অতীতে কোনো নারীর ফাঁসি কার্যকর না হওয়া ইতিহাস হলেও ভবিষ্যতে এটি অব্যাহত থাকবে- এমন নিশ্চয়তা নেই। রাষ্ট্র যদি নতুন নজির গড়ে, তবে তা হবে-
* আইনি যুক্তি,
* সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা,
* রাজনৈতিক প্রভাব,
* আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
-এই চার স্তরের সম্মিলিত বিবেচনায়। এই সিদ্ধান্ত যেমন রাষ্ট্রশক্তির প্রতিফলন, তেমনি নতুন বিতর্কেরও জন্ম দিতে পারে।
▪️ মানবিক ঝুঁকি বনাম রাজনৈতিক ঝুঁকি
মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক দীর্ঘদিনের। অনেক দেশ এটি অমানবিক ও ভুল সংশোধনযোগ্য নয় বলে বাতিল করেছে। অন্যদিকে কিছু দেশ অপরাধদমনে এখনও এটিকে কার্যকর মনে করে।
কিন্তু একজন নারী আসামি, তার ওপর একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী- এখানে মৃত্যুদণ্ডের নৈতিকতা, আইনি বাধ্যবাধকতা, রাষ্ট্রের নীতি, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক স্থিতির প্রশ্ন এক সঙ্গে এসে দাঁড়ায়। ফলে সাধারণ মামলার মতো এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া কখনোই সহজ নয়।
▪️ সমাপনী ভাবনা
বাংলাদেশে নারীর ফাঁসি কার্যকরের নজিরহীনতা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট। তবে প্রেক্ষাপট রায় নির্ধারণ না করলেও রায় বাস্তবায়নের পথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। শেখ হাসিনার রায়ও এখন সেই দীর্ঘ বিতর্কের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
রাষ্ট্র কি তার ঐতিহাসিক নীতিকে অক্ষুণ্ণ রাখবে, নাকি নতুন কোনো প্রমাণ্য নজির স্থাপন করবে- এর উত্তর নির্ভর করবে আসন্ন আইনি প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের ওপর।
এ মুহূর্তে একটি বিষয়ই নিশ্চিত- রায় ঘোষণার পর দেশ ঠিক কোন পথে যাবে, তার উত্তর সময়ই দেবে।
লায়ন ড. এ জেড এম মাইনুল ইসলাম পলাশ
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক